আদম (আ) এর সৃষ্টির ইতিহাস: আল্লাহ তা‘আলা হযরত আদম (আ) কে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা আদি মানব হযরত আদম (আ) কে দুনিয়ার বিভিন্ন স্থানের মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। কাবা ঘরের মাটি দ্বারা মাথা, পাক-ভারতের মাটি দ্বারা পেট ও পিঠ, দুনিয়ার পূর্ব সীমান্তের মাটি দ্বারা দু হাত এবং পশ্চিম সীমান্তের মাটি দ্বারা দু‘পা সৃষ্টি করা হয়েছে।
আর এক বর্ণনায় আছে, বাইতুল মুকাদ্দাসের মাটি দ্বারা হযরত আদম (আ) এর মাথা বেহেশতের মাটি দ্বারা মুখমন্ডল, পাক-ভারতের মাটি দ্বারা দন্তরাজি, পবিত্র কাবার মাটি দ্বারা হস্তদয়, ইরাকের মাটি দ্বারা পৃষ্টদেশ, জান্নাতুল ফেরদাউসের মাটি দ্বারা কলিজা, তায়েফের মাটি দ্বার জিহ্বা, হাউজে কাওছারের মাটি দ্বারা চক্ষুদ্বয়, পর্বতের মাটি দ্বারা মেরুদন্ড এবং বাবেলের মাটি দ্বারা আদমের অন্যান্য অঙ্গ –প্রত্যঙ্গ তৈরী করা হয়েছে।
অন্য এক হাদিসে বর্ণিত আছে যে, তার মাথা মক্কা শরীফের মাটি দ্বারা, ঘাড় বাইতুল মুকাদ্দাসের মাটি দ্বারা, পেট ও পিঠ আদনের মাটি দ্বারা,হস্ত দ্বয় পাক-ভারতের মাটি দ্বারা, পদদ্বয় দুনিয়ার পূর্বসীমান্তের মাটি দ্বারা এবং অস্থি, চর্ম ও মাংস পশ্চিম সীমান্তের মাটি দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে। এভাবে হযরত আদম (আ) এর দেহ তৈরী করে তা বেহেশতের একপাশে একাধারে চল্লিশ বছর পর্যন্ত সংরক্ষিত ছিল।
হযরত আদম (আ) এক আকৃতি তৈরীর জন্য দুনিয়ায় কতিপয় নির্দিষ্ট জায়গা হতে মাটি সংগ্রহের জন্য হযরত জিবরাঈল (আ) কে আদেশ করলেন। তিনি দুনিয়ায় এসে যথাস্থানে গিয়ে মাটির জন্য যমিনে হাত রাখলেন, কিন্তু যমিন তাতে অসন্মত হয়ে জিবরাঈল (আ) কে আল্লাহর কসম দিয়ে বলল, হে জিবরাঈল (আ) আল্লাহর কসম, তুমি আমার দেহ হতে মাটি নিও না। আল্লাহর কসম দিয়ে নিষেধ করায় হযরত জিবরাঈল (আ) মাটি না নিয়ে আল্লাহর দরবারে ফিরে এসে বললেন, হে আল্লাহ ! আপনি আমাকে মাটি আনতে আদেশ করেছেন, কিন্তু যমিন আপনার নামেই কসম দিয়ে নিষেধ করায় আমি মাটি আনতে পারলাম না।
হযরত জিবরাঈল (আ) এর মাটি আনতে অক্ষমতার কথা শুনে আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতা মিকাঈল (আ) কে মাটির জন্য পাঠিয়ে দিলেন। বলাবাহুল্য, এভাবে আল্লাহর কসম দিয়ে নিষেধ করায় ফেরেশতা মিকাঈলও খালি হাতে আল্লাহর দরবারে ফিরে গিয়ে নিজের অক্ষমতা প্রকাশ করলেন। তখন আল্লহ তায়ালা এ কাজের জন্য ফেরেশতা ইসরাফীল (আ) কে নিয়োগ করলেন, কিন্তু একই কারণে তিনিও বিফল হয়ে ফিরে আসলেন।
অবশেষে আল্লাহ তায়ালা এ কাজের জন্য ফেরেশতা আজরাঈল (আ) কে প্রেরণ করলেন । আজরাঈল (আ) পৃথিবীতে এসেই যথাস্থানে উপস্থিত হয়ে যমিন থেকে মাটি নিয়ে গেলেন।যমিনের কথায় কোন কর্ণপাতও তিনি করলেন না।তিনি বললেন, যমিন, তুমি যে আল্লাহর কসম দিচ্ছ, সে আল্লাহ তায়ালাই আমাকে মাটি নিতে প্রেরণ করেছেন। কাজেই তোমার কথায় আমি আল্লাহর আদেশ পালতে বিরত হতে পারি না। এ বলে তিনি মাটি নিয়ে আল্লাহর দরবারে পেশ করলেন।
অতঃপর আল্লাহর নির্দেশে ফেরেশতারা মাটি তায়েফ ও মক্কা শরীফের মাঝখানে রেখে দেন। তখন আল্লাহর রহমতের বৃষ্টি তার উপর বর্ষিত হয় , এতে দু বছরে মাটি কাদায় পরিণত হয়। চতুর্থ বছরে মাটি খননে এবং ষষ্ঠ বছরে শুকনা মাটিতে রূপান্তরিত হয়। অষ্টম বছরে হযরত আদম (আ) এর আকৃতি সৃষ্টি হয়। তখন একদিন ইবলীস সত্তর হাজার ফেরেশতা সাথে নিয়ে আদম (আ) এর নিকট এসে দেখে, তার দেহ পিন্জর মাটিতে পড়ে রয়েছে। এসময় ইবলীস তার প্রতি অসন্মানের দৃষ্টিতে দেখে।
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, একদিন অভিশপ্ত ইবলীস হযরত আদম (আ) এর দেহ পিন্জরাভান্তরে নাভি পর্যন্ত গিয়ে পৌছে। কিন্তু আদম (আ) এর দেহ পিন্জরে ভিষণ উত্তাপের কারণে সে বের হয়ে আসে। এতে আদম (আ) এর প্রতি ইবলীসের হিংসা বিদ্বেষ শত্রুতা ক্রমান্বয়ে বেড়ে যায় এবং আদম (আ) এর দেহ পিন্জরের উপর থুথু ফেলে চলে আসে। জিবরাঈল (আ) আল্লাহর নির্দেশে আদমের দেহ পিন্জর থেকে ইবলীসের থুথু নিয়ে তা থেকে কুকুর সৃষ্টি করেন।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) এর পবিত্র রূহ আরশে অবস্থান করে তাসবীহ পাঠ করছিল, তখন রাসূলুল্লাহ (সা) ঘামের ফোটা সেখান থেকে টপকে ঐ স্থানে পড়ে যেখানে এখন তার শেষ বিশ্রামস্থল হয়েছে। আল্লাহর আদেশ হযরত জিবরাঈল (আ) সেখানকার মাটিতে মেশক-আম্বর মিশিয়ে সুগন্ধযুক্ত করে তা হযরত আদম (আ) এর মুখমন্ডলে মেখে দেন। এর ফলে হযরত আদম (আ) এর চেহারার নূর দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়।
হযরত আদম (আ) এর দেহে রূহ প্রবেশ
এ ঘটনা চল্লিশ দিন পর হযরত আদম (আ) এর রূহ সৃষ্টি হলে তখন জিবরাঈল,মীকাঈল ও আযরাঈল (আ) এর প্রতি আদমের রূহ দেহ পিন্জরে পৌছে দেয়ার আদেশ করা হয়। তাদের প্রত্যেকের সাথে সত্তর হাজার ফেরেশতা । হযরত আদম (আ) এর রূহ একটি নূরের পাত্রে করে আরেকটি নূরের ঢাকনা দিয়ে ঢেকে এনে আদম (আ) এর মস্তকের উপর রেখে ঢাকনা উঠিয়ে ফেলে। কেমন করে আদম (আ) এর রূহ দেহ পিন্জরে প্রবেশ করে তা দেখার জন্য সপ্ত আকাশে ফেরেশতার আগমন হয়। যখন শব্দ হল- হে রূহ! এ দেহ পিন্জরে প্রবেশ কর। তখন হযরত আদম (আ) এর রূহ দেহ পিন্জরের চারদিকে সাতবার চক্কর দেয়।
কিন্তু ভেতরে প্রবেশ করতে না পেরে নিবেদন করে হে আল্লাহ! আমি নূরের তৈরী, আর এ দেহ পিন্জরের অন্দকার আবর্জনাপূর্ণ, কেমন করে আমি এতে প্রবেশ করব। আবার শব্দ হল-হে আদমের রূহ !অনিচ্ছায় এ দেহ পিন্জরে প্রবেশ কর এবং অনিচ্ছায় বের হয়ে এসো। এ নির্দেশ পেয়ে আদম (আ) এর রূহ রন্ধ্র পথে দেহ পিন্জরে প্রবেশ করে মস্তিস্কের চতুর্দিকে ঘুরতে থাকে। যখন হযরত আদম (আ) চোখ খোলেন তখন তার রূহ মাথা থেকে কন্ঠনালীতে, কন্ঠনালী থেকে বক্ষে এবং বক্ষ থেকে নাভি পর্যন্ত পৌছে, কর্দমাক্ত দেহ পিন্জর গোশত, হাড়, অস্থিমজ্জা ও অস্ত্রে রূপান্তরিত হওয়ার ফলে আল্লাহর কুদরতে হযরত আদম (আ) যমীনের উপর হাতে ঠেস দিয়ে উঠতে চান।
তখন ফেরেশতারা বলে উঠেন-এ বান্দাহ ত্বরাপ্রবণ হবে। এখনও তার শরীর অর্ধেক কর্দমাক্ত অথচ সে ওঠতে চাচ্ছে। হযরত আদম (আ) স্বীয় দেহের প্রতি তাকিয়ে দেখলেন, আল্লাহ পাক তাকে কি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। এ সময় তার রূহ, জোড়া, রগসমূহ, গোশত, হাড় ও অস্থিমজ্জা, মোট কথা সমস্ত শরীরে বায়ুর ন্যায় ঘুরতে থাকে। তখন হযরত আদম (আ) এর মস্তককে শুয়ে দেয়ার এবং চেহারা মর্দনের জন্য ফেরেশতাদের পাঠান হয়। এর অল্পক্ষণ পরেই তার হাঁচি আসে। আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আগত এলহামের শিক্ষানুসারে হযরত আদম (আ) আলহামদু লিল্লাহ বলে উঠেন। উত্তরে আল্লাহ পাকের তরফ থেকে বলা হয় ইয়ারহামুকাল্লাহ।