হযরত ইরদীস (আ.) এর খিলাফত
যখন হযরত ইরদীস আল্লাহর পৃথিবীতে খিলাফত তথা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী হলেন তখন জ্ঞান ও কর্মের অনুপাতে তিনি আল্লাহর সৃষ্টিকে (মানবকে) তিন শ্রেণীতে বিন্যাস করেন।যথা কাহিন, সম্রাট ও প্রজা। কাহিনের মর্তবা ছিল সবার উপরে। কেননা তাকে আল্লাহ তাআলার সামনে নিজের ব্যক্তিগত ব্যাপার ছাড়াও সম্রাট ও প্রজাদের ব্যাপারে জবাবদিহি করতে হবে।অতপর ছিল সম্রাটের মর্তবা। কেননা তাকে একাধারে নিজের এবং রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে জবাবদিহি করতে হত। আর যেহেতু প্রজাকে শুধু নিজের নফস সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হত তাই তার মর্তবা ছিল তৃতীয় শ্রেণীর। তবে ঐ সব শ্রেণীর বিন্যাস দায়িত্ব পালনের প্রেক্ষিতে ছিল-বংশও কবীলা অনযায়ী ছিল না।মোট কথা হযরত ইদরীস (আল্লাহর দিকে উঠিয়ে নেয়া) পর্যন্ত উল্লেখিত দীনী ও রাষ্ট্রীয় নীতিমালা প্রচার করেন।
উপরে বণির্ত চারজন সম্রাটের মধ্যে আসকালীবুস ছিলেন অন্যন্ত দৃঢ়চেতা শাসক। তিনি হযরত ইদরীসের বাণী এবং তার প্রবর্তিত নীতিসমূহ সংরক্ষণ করেন অধিক সুষ্ঠুভাবে। হযরত ইদরসীকে উঠিয়ে নিয়ে যাবার পর এই সম্রাট অধিক দুঃখিত ও মর্মহত হন এবং তাঁর ছবি ও তাঁকে উঠিয়ে নিয়ে যাবার দৃশ্য উৎকীর্ণ করে রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
আসকালীবূস সেই ভূখন্ডেই রাজত্ব করতেন, যাকে নূহের প্লাবনের পর ইউনান বা গ্রীস বলা হত। গ্রীকরা প্লাবনের ধ্বংসারশের থেকে কোন না কোন ভাবে বেচেঁ যাওয়ার আধো উৎকীর্ণ ছবিসমূহ পেল যখন দেখতে এবং আসকালীবূসের পরাক্রম ও তার লিপিবদ্ধ বিজ্ঞান ও দর্শনের খ্যাতি গুনল তখন তাদের ভূল ধারণা হল আককালীবূসই হচ্ছেন সেই ব্যক্তি যাকে উপরে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। কিন্তু এটা ছিল তাদের সম্পূর্ণ একটা ভ্রান্তিমূলক ও অনুমান ভিত্তিক কথা।
হযরত ইদরীসের আকার আকৃতি ও চাল চলন
হযরত ইদরীসের আকার আকৃতি ও চাল চলন ছিল নিম্নরূপ ঃ রং বাদামী, মাথার চুল পাতলা, সুদৃশ্য চেহারা, ঘনদাড়ি, রং রূপ ও চেহারার আদলে লাবণ্য, সুদৃঢ় হস্তদ্বয়, প্রশস্ত কাঁধ, মজবুত অস্থি দুবলা, পাতলা লাজুক লাজুক অথচ তেজোদীপ্ত আঁখিযুগল, গম্ভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ কথাবার্তা, ধীর স্থির চালচলন, একা একা চিন্তা ভাবনায় রত থাকতে আগ্রহী, কথা বলার সময় বার বার তর্জনী হেলানো, ক্রোধের কারণ দেখা দিলে খুবই ক্রাধান্বিত হওয়া এবং পথ চলার সময় নিচের দিকে দৃষ্টি রাখা সংক্ষেপে এই ছিল ইদরীসের আকার আকৃতি ও চালচলন।
তিনি মোট ৮২বছর হায়াত পেয়ে ছিলেন।তাঁর অংগুলিতে নিম্নলিখিত বাক্যটি খোদাই করে লেখা ছিল। অর্থাৎ আল্লাহর উপর ঈমান এবং সে সাথে ধৈর্যাবলম্বন মানুষকে সাফল্যের অধিকারী করে। অর্থাৎ, সত্যিকার ঈদ আল্লাহর ফারায়েয (আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত অবশ্য পালনীয় দায়িত্বসমূহ পালনের মধ্যেই নিহিত আর দীনের পরিপূর্ণতা শরীয়ত ও মায়ুওয়াত (চক্ষুলজ্জা) এর পরিপূর্ণতার সাথে সম্পর্কযুক্ত।
আর জানাযার নামায আদায়ের সময় তিনি মাথায় যে পটকা বাঁধতেন তাতে লেখা ছিল, ভাগ্যবান সে ব্যক্তি তার নফসের (কাজকর্মের) প্রতি দৃষ্টি রাখে। আর আল্লাহর সামনে মানবের প্রকৃতি সুপারিশকারী হচ্ছে তারই পুণ্যকর্ম।
হযরত ইদারীসের চরিত্রগঠনমূলক অনেক উপদেশবাণী রয়েছে বা প্রবাদ বাক্যে পরিণত হয়েছে এবং বিশ্বের সর্বত্রই অনুকরণীয় অতি মূল্যবান নীতিবাক্য হিসাবে স্বীকৃতি অর্জন করেছে। যেমনঃ
(১) আল্লাহর অগণিত নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় মানবের সাধ্যের অতীত।
(২) যে ব্যক্তি ইলমে পারদর্শী হতে চায় সে যেন মূর্খতার চৌহদ্দীতেও না যায়, আর যে পুণ্যকর্মে অনুগামী হতে চায় সে যেন অসৎকর্মের ধারে কাছেও না ঘেসে।
(৩) আমি আল্লাহকে চাই, আবার পৃথিবী চাই- এটা একটা অবাস্তব কল্পনা ওি পাগলামী ছাড়া কিছু নয়।
(৪) নিয়্যাত (কাজ করার জন্য সংকল্প বন্ধ হওয়া) হচ্ছে আল্লাহকে যিকির বা স্মরণ ও সৎকর্ম সম্পাদনের পূর্বশর্ত।
(৫) হীন কাজকর্মকে (শিঙ্গা লাগানো, পশুর সংগম কাজ সমাধা করে পারিশ্রমিক গ্রহণ ইত্যাদি কখনো নিজের পেশা হিসাবে গ্রহন করো না।
(৬) শাসনকর্তৃপক্ষ (যদি সে আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী শাসন কর্ম চালায়) অনুগত থেকে বড়দের সামনে বিনম্র হও এবং সর্বদা আল্লাহর স্মরণে জিহবাকে সজীব রেখ।
(৭) হিকমত (বিজ্ঞতা) হচ্ছে রূহের আত্মার জীবন।
(৮) অন্যের সৌভাগ্য দেখে হিংসা করো না। কেননা সৌভাগ্য মাত্রই ক্ষণস্থায়ী।
(৯) যে নিজের প্রয়োজনের চেয়ে অধিক চায় সে কখনো তৃপ্তি লাভ করতে পারে না।
(১০) যার চেষ্টা নিরলস আন্তরিক তার সাফল্য অনিবার্য।
তারীখুল হুকামা গ্রন্থের ৩৪৮ পৃষ্ঠায় তৃতীয় হারমাসের আলোচনা প্রসঙ্গে করা হয়েছে, আলিমদের একটি দল এ মতামত পোষণ করেন নূহের প্লাবনের পূর্বে বিশ্বে যত রকরেম ইলমের প্রচলন ছিল তার সবগুলোরই প্রথম শিক্ষক তথা উদ্ভাবক ছিলেন প্রথম হারমাস। তিনি মিসরের উচ্চভূমির অধীবাসি ছিলেন। গ্রীক পন্ডিতরা তাকে খানুখ নামীয় নবী এবং হযরত আদমের ষষ্ঠতম অধঃস্তর পুরুষ হিসাবে মান্য করেন। তার বংশলতিকা হচ্ছে খনুখ (ইদরীস) বিন ইয়ারদ বিন শীস বিন আদম (আ)।
তারা এ মতামত ও পোষন করেন আল্লাহর ইবাদতের জন্য ইবাদতগাহ নির্মাণ, জোতিষ শাস্ত্র, চিকিৎসা শাস্ত্র এবং উপমার সাহায্যে আকাশ ও পৃথিবী সম্পর্কিত বিষয়াদির ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ তাঁরই সর্বপ্রথম উদ্ভাবন। তিনিই সর্বপ্রথম একটি প্রলংকারী প্লাবন সম্পর্কে ভবিষ্যবাণী করেন। তিনি বলেন, আমাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে এমন একটি আসমানী আপদরূপে ঐ প্লাবনের দৃশ্য অবলোকন করা হয়েছে, যা একাধারে আগুন পানি দ্বারা সমগ্র ভূভাগ গ্রাস-করে ফেলছে।
এই দৃশ্য অবলোকন করে জ্ঞানবিজ্ঞান ও শিল্প বাণিজ্যের ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কেও তিনি চিন্তিত হয়ে পড়েন। যার ফলশ্রুতিতে তিনি মিসরে পিরামিড ও বারবী (২) নির্মাণ করে তাতে সবরকম শিল্প বাণিজ্য ও নব আবিষ্কৃত যন্ত্রপাতির ছবি অংকন করেন ও সব রকম জ্ঞানবিজ্ঞানের তত্ত্ব ও তথ্যাদি লিপিবদ্ধ করে রাখেন যাতে সর্বপ্রাসী প্লাবনের কারণে এসব একেবারে ধ্বংস হয়ে না যায়।