হযরত নূহ (আঃ) এ জাহাজ নির্মাণ

হযরত নূহ (আঃ) এ জাহাজ নির্মাণ

আল্লাহ তাআ‘লা হযরত নূহের ফরিযাদ গ্রহণ করলেন এবং তাঁর নির্ধারিত কর্মের প্রতিফল প্রদানের নীতি অনুযায়ী এই সীমালংঘনকারীদের সীমালংঘনের শাস্তি ঘোষণা করলেন।প্রথমে সতর্কতামূলক ভাবে হযরত নূহ (আ) কে একটি জাহাজ তৈরির নির্দেশ দেয়া হলো, যাতে বাহ্যিক কার্য কারণের প্রেক্ষিতে তিনি এবং আল্লাহতে বিশ্বাসী দাসরা অবাধ্যদের উপর আপতিত শাস্তি থেকে নিজেদের হেফাজত করতে পারে না আল্লাহর নির্দেশে যখন নূহ (আ) জাহাজ তৈরি কার আরম্ভ করলেন তখন অবিশ্বাসীরা তা নিয়ে হাসাহাসি শুরু করে দিল। যখন তারা এদিক দিয়ে যে তখন রসিকতা চড়ে রক্ষা পাবে? কী আহাম্মকি খেয়ালরে বাবা। হযরত নূহ (আ) তাঁদের এই হাসাহাসির প্রতি কোন গুরুত্ব না দিয়ে নিজের কাজ নিয়ে তর থাকতেন। কেননা আল্লাহ তাআ‘লা পূর্বাহ্নেই তাকে আসল অবস্থা সম্পর্কে সতর্ক করে   দিয়াছিলেন।

তুমি আমার তত্ত্বাবধানে আমার অহী বা প্রত্যাদেশ অনুযায়ী নৌকা তৈরি কর এবং যারা সীমা লঙ্ঘন করেছে তাদের সম্পর্কে তুমি আমাকে কিছু বলো না, তারা তো নিমজ্জিত হরে।(সূরাঃ হুদ আয়াতঃ৩৬)

শেষ পর্যন্ত হযরত নূহ (আ)-এর জাহাজ তৈরি হয়ে গেল। এই সাথে এসে গেল আল্লাহর আযাব অবতীর্ণ হওয়ার সময়। হযরত নূহ (আ) প্রথমে সেই চিহ্নটি প্রত্যক্ষ করলেন যার কথা তাকে ইতিপূর্বে জানান হয়েছিল। অর্থাঃভূমির তলদেশ থেকে পানির ফোঁয়ারা উঠতে লাগলো।তখন অহীর মাধ্যমে নূহকে নির্দেশ দেয়া হলো, তুমি তোমার সংসার পরিজনকে জাহাজে আরোহণ করতে বল, প্রত্যেক জাতের প্রাণীর এক একটি জোড়াকেও তাতে আশ্রয় দাও এবং সেই ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী (আনুমানিক ৪০ জন) যারা তোমার উপর ইমান এনেছে তাদেরকেও আরোহণ করতে বলা।

যখন আল্লাহর হুকুম আনুযায়ী সব কাজ সম্পন্ন হল তখন আকাশকে বৃষ্টিবর্ষণের এবং জমিকে ফোঁয়ারা উদগীরণের নির্দেশ দেওয়া হল।

যখন আল্লাহর হুকুমে সব কিছু-ঘটে গেল তখন তাঁরই রক্ষণাবেক্ষনে জাহাজটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পানির উপর ভাসতে থাকলো। সত্য-প্রত্যাখ্যানকারী দুরাচারীরা পানিতে ডুবে মারা এবং নিজেদের দুস্কর্মের সেই প্রতিফল ভোগ করলো, যার প্রতিফল প্রদানের রীতি অনুযায়ী আল্লাহ তাআলা তাদের জন্য নির্দিষ্ট করে রেখেছিলেন।

নূহের ছেলের অবস্থা

এখানে একটি বিষয় বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। হযরত নূহ (আ) তুফানী শাস্তি অবতরণের সময় আপন ছেলের মুক্তির জন্য আল্লাহর দরবারে সুপারিশ করেছিনে। কিন্তু আল্লাহ তাআলার তার সেই সুপারিশ প্রত্যাখ্যান করেন। এই বিষয়টি কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতে বেশ গুরুত্ব সহকারে বর্ণনা করা হয়েছে।

নূহ তার প্রভুকে সম্বোধন করে বললো, হে আমার প্রভু আমার ছেলে আমার সংসার  ভুক্ত এবং আপনার প্রতিশ্রুতি  সত্য এবং আপনি বিচারকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বিচারক। তিনি বললেন, হে নূহ সে তোমার সংসারভুক্ত নয়। সে অসৎকর্ম পরায়ণ । সুতরাং যে বিষয়ে তোমার ইলম নেই সে নিয়ে আমাকে অনুরোধ করো না। আমি তোমাকে, উপদেশ দিচ্ছি তুমি যে অজ্ঞদের অন্তভুক্ত না হও।

সে বললো, হে আমার প্রভু, যে বিষয়ে আমার ইলম নেই সে বিষয়ে যাতে আপনাকে অনুরোধ না  করি এজন্য আমি আপনার পানাহ দিচ্ছি। আপনি যদি আমাকে ক্ষমা ন করেন এবং দয়া না করেন তবে আমি ক্ষমিগ্রস্তদের গণ্য হব। বলা হল, হে নূহ অবতরণ কর আমার দেয়া শান্তিসহ এবং তোমার প্রতি ও যে সব কওম তোমার সঙ্গে আছে তাদের প্রতি কল্যাণসহ। (সূরা নূহঃ আয়াতঃ৪৫-৪৮)

উপরোক্ত আয়াতসমূহ থেকে বুঝা যাচ্ছে হযরত নূহের প্রতি আল্লাহর প্রতিশ্রুতি ছিল তিনি তাঁর সংসার পরিজনকে শাস্তি থেকে  মুক্তি দেবেন। তাই হযরত নূহ (আ) আপন ছেলের (কোরআন) জন্য আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ জানান। কিন্তু প্রভুর কাছ থেকে তাকে সাবধান করে দেয়া হয়, যে বস্তুর জ্ঞান তোমার নেই সে সম্পর্কে এভাবে ফরিয়াদ করার কোন অধিকারও তোমার নেই। হযরত নূহ (আ) তার ভুল বুঝতে পারেন। তাই ক্ষমাপ্রার্থী হন আল্লাহর দরবারে। তখন আল্লাহ যে উত্তর দেন তাতে তিনি আশ্বস্ত হন। 

এখন লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হলো, হযরত নূহ (আ) কোন অঙ্গিকারের উপর ভিত্তি করে ঐ প্রশ্ন। করেছিলেন? সে অ ঙ্গিকার কি পূর্ণ হয়েছিল? হযরত নূহ (আ) ঐ অঙ্গিকার অনুধাবন করতে কি ধরনের ভ্রান্তির শিকারে পরিণত হয়েছিলেন? আর আল্লাহর সতর্ক বানী উচ্চারণের পর তিনি কি ভাবে মূল বিষয়টি অনুধাবন করলেন?

অবশেষ আমার নির্দেশ আসলে ভূপৃষ্ঠ প্লাবিত হল। আমি বললাম, এতে উঠিয়ে নাও প্রত্যেক জীবের এক এক জোড়া, যাদের বিরুদ্ধে পূর্ব সিদ্ধান্ত হয়েছে তারা ছাড়া তোমার সংসার পরিজনকে যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে। তার সঙ্গে ঈমান এনেছিল অল্প কয়েক জন। (সূরা হুদঃ আয়াতঃ৪০)

উপরোক্ত আয়াতে বলা হয়েছে, হযরত নূহকে আল্লাহতালা বললেন, তোমার সংসার পরিজনের মধ্যে যারা ‍মুক্তি প্রাপ্ত তাদেরকে জাহাজে উঠিয়ে নাও, কিন্তু তোমার সম্পূর্ণ সংসার তো আর মুক্তি প্রাপ্ত নয়, বরং তাদের মধ্যে কেউ কেউ এমনও আছে যাদের উপর আল্লাহর আযাব নির্দ্ধারিত হয়ে গেছে।

যেহেতু হযরত নূহ (আ) তাঁর বিবির কাফির সুলভ আকায়েদ (বিশ্বাস) ও আমল (কর্ম) এর প্রতি দৃষ্টি রেখে সে যে আল্লাহর উপর ঈমান আনবে এবং তার একত্বকে স্বীকার করে নেবে সে মস্পর্কে পুরোপুরী হতাশ হয়ে পড়েছিলেন, তাই তিনি উপারাক্ত ব্যতিক্রমের উপর লক্ষ্য শুধু নিজের বিবিকেই মনে করে ছিলেন এবং পুত্র স্নেহে বিভোর হয়ে এ ধারণা করেছিলেন যে, সেহেতু অল্প বয়স্ক তাই জাহাজে আরোহণ করলে মুমিনদের সুহবত পেয়ে হয়ত আল্লাহর উপর ঈমান আনবে এবং তার উপর কাফিরদের যে খারাপ প্রভাব পড়েছে তাও আস্তে আস্তে দূর হয়ে যাবে।

জাহাজের উঠিয়ে নাও…………তোমার পরিবার পরিজনকে…আল্লাহর এই নির্দেশের সুযোগ হযরত নূহ (আ) আপন ছেলে কোরআনের মুক্তির জন্য আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ জানিয়েছিলেন। কিন্তু আল্লাহ তাআলা তার মহাসম্মানিত নবীর এই আচরণ পছন্দ করেননি, তাই তাঁকে সতর্ক করে দেন এবং এ মর্মে যে সর্বদা আল্লাহর অহী প্রাপ্ত হয় এমন ব্যক্তির পক্ষে আল্লাহর অহীর অপেক্ষা না করেই পূত্রস্নেহে বিভোর হয়ে অনুমান ভিত্তিক এমন একটা কর্ম করা (পুত্রের মুক্তির জন্য ফরিয়াদ জানানো) মোটেই উচিত হয়নি। কেননা মুক্তির প্রতিশ্রুতি মুমিনদের জন্য, আর কেনআন মুমিন নয় বরং কাফির। অতএব সে কাফিরদের সাথেই থাকবে তার মুক্তির জন্য ফরিয়াদ করা একজন নবীর পক্ষে মোটেই সাজে না। 

হযরত নূহের প্রতি আল্লাহর ঐ সম্বোধন শাস্তিস্বরূপ ছিল না বরং তা ছিল হাকীকত (মূলতন্ত্ব) প্রত্যক্ষ করার একটি আহবান, যা হযরত নূহ শুনেছিলেন এবং মানব সুলভ দুর্ভলতাকে মেনে নিয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থী হয়েছিলেন এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে শান্তি ও বরকত লাভ করে ধন্যও হয়েছিলেন।

অতএব তাঁর ফরিয়াদের মধ্যে যেমন অবাধ্যতার নাম নিশানা ছিল না তেমনি তা ছিল না নবীদের ইসমত (নিল্পাপ হওয়া) বিরোধী কোন চিহ্ন। তাই আল্লাহতাআ‘লা এটাকে অজ্ঞতা আখ্যা দিয়াছেন পাপাচার বা অবাধ্যতা আখ্যা দেননি।

মোটকথা হযরত নূহের কাছে যখন এ তত্ত্বটি স্পষ্ট হয়ে গেল মুক্তির প্রতিশ্রুতি বংশ বা গোত্রভিত্তিক নয় বরং ঈমান বিল্লাহ (আল্লাহর-উপর ঈমান) ভিত্তিক তখন তিনি তার কথার মোড় ঘুরিয়ে নিয়ে কেন আনকে ঈমান বিল্লাহের দিকে আহবান জানালেন। আশা করলেন, সেও মুমিন হয়ে আল্লাহ প্রদত্ত জান্নাতের (পরিত্রাণ) অধিকারী হবে। কিন্তু সে হতভাগ্য উত্তর দিল, সে বললো, আমি এমন এক পর্বতে আশ্রয় নেব যা আমাকে প্লাবন থেকে হেফাজত করবে।(সূরা হুদঃ আয়াতঃ৪৩)

তার উত্তরে শুনে হযরত নূহ (আ) বললেন, সে (হযরত নূহ) বললো, আজ আল্লাহর বিধান থেকে হেফাজত করবার কেউ  নেই, শুধু হেফাজত পাবে সে যাকে আল্লাহ দয়া করবেন। এরপর তরংগ ওদেরকে বিচ্ছিন্ন করে দিল এবং সে নিমজ্জিতদের অন্তর্ভুক্ত হল।(সূরা হুদঃ আয়াতঃ৪৩)

জুদি পর্বত

যখন আল্লাহর হুকুমে শাস্তির অবসান হল তখন নূহের জাহাজ জুদি পর্বতে গিয়ে ঠেকলো। এবং কাজ সমাপ্ত হলো, জাহাজ জুদি পর্বতের উপর স্থির হলো এবং বলা হলো, ধ্বংসই সীমা লংঘনকারী কওমের পরিণাম। (সূরা হুদঃ আয়াতঃ৪৪)ৎ

তাওরাতে জুদীকে আরারাত পর্বত শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত বলা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে আরারাত একটি উপদ্বীপ তথা ঐ অন্চলের নাম যা ফুরাত ও দজলার মধ্যবর্তী ভূভগু দিয়ারে বকর থেকে বাগদাদ র্পন্ত বিস্তৃত।

ধীরে ধীরে পানি শুকিয়ে গেল এবং জাহাজের আরোহিরা দ্বিতীয়বার শান্তি নিরাপত্তার সাথে আল্লাহর যমীনে পদাপর্ণ করল। একারণেই হযরত নূহ (আ) কে দ্বিতীয় আবুল বশর বা দ্বিতীয় আদম (মানব জাতির দ্বিতীয় জনক) বলা হয়। সম্ববতঃএই প্রেক্ষিতেই হাদীসে তাকে (প্রথম রসূল) বলা হয়েছে।

হযরত নূহের ঘটনার সমাপ্তি এখানেই। তবে এ গুরুত্বপূর্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে সব প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছে সেসব সম্পর্কেও আলোচনার পর্যালোচনার প্রয়োজন রয়েছে।

নূহের প্লাবন সামগ্রিক ছিল না আঞ্চলিক ছিল?

নূহের প্লাবন বিশ্বব্যাপী ছিল, না কোন এক বিশেষ অঞ্চলের উপর এই প্রশ্নের উপর প্রাচীনপন্থী ও নবীন পন্থী উলামারা বরাবরই দ্বিধা বিভক্ত। মুসলিম উলামার একটি দল,ইহদী ও খ্রীষ্টানগণ এবং কোন কোন জ্যোতিষ শাস্ত্রবিদ এবং ভুপৃষ্ঠবিদ প্রকৃতি বিজ্ঞানী এ মতামত পোষণ করেন এই প্লাবন পৃথিবীব্যাপী ছিল না বরং ঐ অঞ্চলের উপরই সীমাবদ্ধ ছিল যেখানে হযরত নূহের সম্প্রদায় বসতি স্থাপন করেছিল। ঐ অঞ্চলের আয়তন ছিল একলক্ষ চল্লিশ হাজার বর্গ কিলোমিটার।

তাদের মতে, নূহের প্লাবন অঞ্চল ভিত্তিক না হয়ে যদি পৃথিবীব্যাপী হত তবে তার নিদর্শনসমূহ ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন অঞ্চলে এবং বিভিন্ন পর্বরেত শীর্ষদেশে অবশ্যই পাওয়া যেত। কিন্তু বাস্তবে তে তা, পাওয়া যায় না। তাছাড়া ঐ যুগে মনুষ্যবসতি ছিল কম এবং শুধু ঐ অঞ্চলেই তা সীমাবদ্ধ ছিল, যেখানে হযরত নূহ (আ) এবং তাঁর সম্প্রদায় বসবাস করত। তখন পর্যন্ত হযরত আদমের বংশধর এর চেয়ে বেশি ছিলও না। অতএব শুধু ওরাই ছিল শাস্তিযোগ্য এবং প্লাবনের শাস্তিও তাদের উদ্দেশ্যেই পাঠানো হয়েছিল। ভূপৃষ্ঠের অন্যান্য অঞ্চলের সাথে এর কোন সম্পর্ক ছিল না।

কিছু সংখ্যক উলামা, ভূপৃষ্ঠবিদ ও প্রকৃতি বিজ্ঞানীর মতে, এই প্লাবন ছিল সমগ্র ভূপৃষ্ঠব্যাপী বিস্তৃত। আর শুধু এই একটি নয় বরং এ ধরনের আরো অনেক প্লাবন পৃথিবীতে হয়েছে।

এরা প্রথমোক্ত দলের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, জামিয়া এবং ইরাকে আরব- এর এই ভূভাগ ছাড়াও অন্যান্য ভূভাগের উচ্চ পর্বতসমূহের এমন এমন সব জন্তুর অস্থির ফসিল পাওয়া গেছে যাদের সম্পর্কে ভূপৃষ্ঠ- বিদের মতামত হলো, এর জলজ প্রাণী এবং শুধু পানিতেই এরা জীবিত থাকতে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের পরবর্তসমূহের শীর্ষদেশ প্রাপ্ত ঐ সমস্ত নির্দেশন থেকে প্রমাণিত হয় কোন এক যুগে পানির এমন একটি ভয়ানক প্লাবন হয়েছিল যা প্লাবিত করেছিল সারা বিশ্বের পর্বতসমূহের শীর্ষ ভাগ। 

উপরোক্ত দুটি অভিমত যথাযথভাবে পর্যালোচনানার পর মুহাক্কিক (তাত্বিক) উলামাগণ যে চূড়ান্ত মতামত ব্যক্ত করেছেন তা হলো ঐ প্লাবান আঞ্চলিক ছিল, সামগ্রিক ছিল না। এ বিষয়টিও এখানে প্রাণিধ্যানযোগ্য সমগ্র মানবজাতির শুধু হযরত নূহের বংশ থেকেই বিস্তার লাভ করেছে এবং আয়াতে কুরআন (তুমি ওদের অব্যহতি দিলে ওরা তোমার দাসদের বিভ্রান্ত করবে।সেদিকেই ইঙ্গিত করবে।

অবশ্য পবিত্র কুরআন আল্লাহর চিরাচরিত বিধান অনুযায়ী এ সমস্ত ব্যাখ্যার উপরই গুরুত্ব আরোপ করেছে যেসব উপদেশ ও শিক্ষা গ্রহণের জন্য আবশ্যকীয়। এছাড়া অপর বিষয়ের উপর কোন গুরুত্বই আরোপ করেনি বরং সেগুলোর উন্নয়ন ও পর্যালোচনার দায়িত্ব মানুষের ইলম ও বিজ্ঞতার উপরই ছেড়ে দিয়েছে কুরআন এখানে একথাই বলতে চায় যাদের বুদ্ধি ও বিবেক রয়েছে তাদের এমন একটি ঐতিহাসিক ঘটনা ভুলে যাওয়া মোটেই উচিত নয়।ঘটনাটি হলো, আজ থেকে হাজার হাজার বছর পূর্বে যখন একটি জাতি আল্লাহর অবাধ্য হল, তাদের প্রতি প্রেরিত পথ পদর্শক হযরত নূহ (আ) এর হেদায়েতকে মিথ্যা আখ্যা দিল এবং তা গ্রহণ করতে স্পষ।ট অস্বীকার করল তখন আল্লাহতাআলা তার কুদরত ও পরাক্রম প্রদর্শন করেন। এক প্রলয়ংকারী প্লাবন আসে এবং তাতে অবাধ্য পথভ্রষ্টরা চিরদিনের জন্য ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু হযরত নূহের অনুসারী মুমিনরা হেফাজত প্রাপ্ত হয়। আল্লাহতাআলা আপন প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন। বিবেক সম্পন্নদের জন্য নিশ্চয়ই এতে উপদেশ শিক্ষা রয়েছে।

নূহ তনয়ের বংশ নিয়ে বিতর্ক 

কোন কোন আলিম হযরত নূহের এই পুত্র সম্পর্কে বলেছেন সে তাঁর আপন পুত্র ছিল না। এ মতের আবার দুটি পৃথক মতামত আছে। একদল বলেন যে সে রাবীব ছিল-অর্থাৎ হযরত নূহের স্ত্রীর প্রথম স্বামীর পক্ষের সন্তান ছিল এবং হযরত নূহের কাছেই লালিত পালিত হয়েছিল। অপরদল হযরত নূহের কাফিরা (আল্লাহকে অস্বীকারকারিনী) স্ত্রীর উপর ব্যভিচারের অভিযোগ উত্থাপন করে বলেন, এ পুত্র ছিল সেই ব্যভিচারেরই ফল।

উপরোক্ত উলামাগণ এসব সনদহীন ব্যাখ্যা প্রদানের প্রয়োজন বোধ করেছেন এ জন্য তাদের ধারণামতে, রসূলের পুত্র কাফির হবে এটা তো একটা অকল্পনায় ব্যাপার।কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার এ তারা কি করে কুরআনের ঐ আয়াতটি বিষ্মৃত হয়ে যান, যাতে বলা হয়েছে, ইবরাহীম (আ)-এর পিতা আযর একজন মূর্তি নির্মাতা ও মুর্তিপূজক কাফির ছিলেন। অতএব একজন উচ্চমর্তবাসম্পন্ন নবীর পিতার কুফরের কারণে যদি সেই নবীর নবুওয়াতে কোন মর্যাদাহানি না হয় তাহলে একজন উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন রসূল ও নবীর পুত্রের কুফরীর কারণে সেই রসূল ও নবীর নবুওত ও সিসালতের মর্যাদাহানি হবে কি করে? বরং একজন সত্যিকার তাত্ত্বিকের দৃষ্টিতে এটা হচ্ছে সেই মহান স্রষ্টার কর্তার পরম প্রভুর অতুলনীয় কুদরতের বহিঃপ্রকাশ যিনি বন্ধ্যা জমিতে গোলাপ ফুলের সাথে কাঁটাও সৃষ্টি করেন।

সুনিপুণ স্রষ্টা আল্লাহ কত মহান। অতএব পবিত্র কুরআনই যখন স্পষ্ট ভাষায় বলেছে কেনআন হযরত নুহেরই পুত্র ছিল তখন অকারণে এই সব সূক্ষ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের কি কোন প্রয়োজন আছে?

একটি নৈতিক জিজ্ঞাসা 

এখানে আল্লামা আবদুল ওহহাব নাজ্জার পবিত্র কুরআনের ব্যাখ্যাকে সমর্থন করেছেন বটে, তবে তাঁর মতে, কুরআনে পরিষআর ভাষ্য অনুযায়ী হযরত নূহের বিবি যদি কাফির হতে পারে তবে তার উপর অসতীত্বের অভিযোগ উত্থাপন করাও তে অন্যায় কিছু নয়।

কিন্তু এধরনের প্রতিটি স্থানে এসব বিশেষ ব্যক্তিদের সাথে আমার মতানৈক্য থেকেই যায় এবং আমি বিস্ময় বোধ করি এসব উলামাদের দৃষ্টি নবী ও রসূলদের ব্যাপারে কেন ঐ সব স্পর্শকাতর বিষয়াদির প্রতি নিবন্ধ হয় না-যা চরিত্র, সংসার যাত্রা ও সভ্যতা সংস্কৃতির সাথে সম্পক্ত।

উদাহরণ স্বরূপ এ স্থানটির কথাই ধরুন যেখানে কাসাসুল আম্বিয়া-এর লেখক এবং কিছু সংখ্যক উলামা বলেছেন,হযরত নূহের বিবি যখন কাফির হতে পারে তখন আসতী হতে পারবে না কেন? কেননা দ্বিতীয় কর্মের অনুপাতে প্রথম কর্মটি তো অনেক বেশি মারাত্মক।

আমি উপরোক্ত মতের ঘোর বিরোধী এজন্য কোন নবীরসূলের স্ত্রী তাঁর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ থাকবে, অতচ অসতীত্বের কাজ করবে এবং তিনি (নবী রসূল) জানতে পারবে না- এমন কথা আমি বিশ্বাস করতে পারি না। একজন পুণ্যবান ব্যক্তির বিবি তার স্বামীর অগোচরে যদি এ ধরনের কুকর্মে রত হয় তবে এটা সম্ভব তিনি এ সম্পর্কে অজ্ঞ থেকে যেতে পারেন, এবং যতক্ষণ পর্যন্ত বিষয়টি তার গোচরে না আসে ততক্ষণ তার পবিত্রতা পুণ্যতা ও আল্লাহ ভীরুতা ও কালিমা লিপ্ত না হতে পারে-কিন্তু কোন নবী রসূলের বেলায় তো এরূপ ঘটতে পারে না।

কেননা তাঁর কাছে সকালসন্ধ্যা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে অহী আসে এবং তিনি আল্লাহর সাথে কথোপকথনেরও সৌভাগ্য অর্জন করেন- এমতাবস্থায় এটা কি করে সম্ভব যে, একজন অসতী ব্যভিচারিণী ত৭ার জীবন সঙ্গিনী থাকবে অথচ আল্লাহর অহী তাঁর কাছে সে তথ্যটি ফাস করবে না? কোন ব্যক্তিকে যখন আল্লাহ তাআ‘লা মানবের হেদায়েত ও পথ প্রদর্শনের জন্য মনোনীত করেন তখন তাকে বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ যাবতীয় দোষত্রুটি থেকে পাক পবিত্র রাখা হয়, যাতে কোন ব্যক্তি তার বংশ স্বভাব চরিত্র ও চাল চলনের উপর কোনরূপ কলংক আরোপ করতে না পারে। এমতাবস্থায় এটা কী করে সম্ভব যিনি আল্লাহর কাছ থেকে অহী প্রাপ্তি ও তার সাথে কথোপকথনের দাবি করে থাকেন তারই গৃহ অসৎ চরিত্রের জীবাণু প্রতিপালিত ও বর্ধিত হবে অতচ তিনি তা থেকে থাকবেন সম্পূর্ণ গাফিল ও অজ্ঞ?

হযরত আয়েশা সিদ্দীকার (রাঃ) ঘটনা আমাদের সামনে এর একটি বড় দৃষ্টান্ত। বিনা সূতায় হাওয়ায় জাল বুননাকারী সেই দুর্নাম রটনাকারীরা হযরত আয়েশা সম্পর্কে কী দুর্নামই না রটনা করল? নবী করীম (স) নিজ কানেও তা শুনলেন। ভাগ্যবান ও ভাগ্যহতদের জন্য বেশ কিছু দিন তা পরীক্ষার বিষয় হয়েও রইলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অহীয়ে ইলাহী মূল ব্যাপারটি এমনভাবে স্পষ্ট করে দিল দুধেল স্থানে দুধ, আর পানির স্থানে পানিই পরিদৃষ্ট হলো।

নবীর বিবি থেকে ব্যভিচারের ঘটনা গুনাহ অপর কথায় জঘন্যতম অপরাধ। কিন্তু সামাজিক ও চারিত্রিক ক্ষেত্রে তা অসদাচরণ এ জঘন্য কিছু নয়, বরং একটি বিশ্বাস, যাকে বড় জোর ভ্রান্ত বিশ্বাস বলা যেতে পারে। এ কারণেই ইসলামের প্রচার কৌশলের দিক বিবেচনা করে নবী (স)-এর পূর্ববর্তী শরীয়তসমূহে এবং খোদ নী (স)-এর মক্কী জবিনেরও কাফিরদের সাথে বিয়েশাদী নিষিদ্ধ ছিল না। অবশ্য মাদানী জীবনে কুরআন স্পষ্ট ভাষায় মুশরিক ও মুসলিমের মধ্যকার বৈবাহিক সম্বন্ধ চিরদিনের জন্য নিষিদ্ধ করে দেয়, কিন্তু বাভিচার কোন অবস্থায়ই এবং কোন সময় বৈধ ছিল না।

এখানে কুফর ও যিনার (ব্যভিচারের) পারস্পরিক পাথর্ক নির্ণং আমাদের উদ্দেশ্য নয়, বরং উদ্দেশ্যে হচ্ছে সামাজিক অসদাচরণ ও সদাচরণের গুরুত্বের দিকটি তুলে ধরা। আর এই প্রেক্ষিতেই বলা যায় হযরত নূহ (আ) এর পবিত্র জীবনের সাথে একজন বাভিচারিণীর বৈবাহিক সম্বন্ধ থাকা একেবারেই অসম্ভব। যদি হযরত নূহের বিবি একটি বারের জন্যও অনুরূপ দুষ্টকর্ম করত তবে আল্লাহ তা‘আলা তাকে (নূহকে) অহী মারফত সে মম্পর্কে অবহিত করে দিতেন। অতপর হয় তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটত, নয়ত ন্যূনপক্ষে তাওরাতুন নাসূহা (আন্তরিকভাবে অনুতপ্ত হওয়ার) এর মাধ্যমে বিষয়টির একটি মীমাংসা হত।

আমি আরো একটু অগ্রসর হয়ে দুঃসাহস করে বলতে পারি আল্লাহ না করূন যদি কোন রেওয়ায়েতের ও এ ধরনের ঘটনার কোন আকার ইঙ্গিত পাওয়া যেত তবু আমাদের দায়িত্ব হত, তার সঠিক ব্যাখ্যা খুজে বের করে মূল হাকীকত (তত্ত্ব) কে সর্বসমক্ষে উপস্থাপন করা। অথচ প্রকৃত ব্যাপার এই না কুরআন এ সম্পর্ক কিছু বলেছে, আর না সহীহ অথবা যয়ীফ (দুর্বল) রেওয়ায়েতে এর কোন আলোচনা এসেছে। এমতাবস্থায় অযথা এ ধরনের দূর দূরান্তের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ যোগ করে পাঠকসমাজের চিন্তাভাবনাকে ভারাক্রান্ত করে তোলার মধ্যে ক্ষতি ছাড়া লাভের কিছুই রয় না।

অতএব মূল ব্যাপার এ কোরআন হযরত নূহেরই ছেলে ছিল। কিন্তু আপন কাফিরা (অবিশ্বাসী) মা ও পথভ্রষ।ট কওমের সুহবত তাকে এমনভাবে প্রভাবিত করে রেখেদিল সে নূহের হেদায়েত ও উপদেশ থেকে উপকৃত হতে পারে নি। অপরকথায় নবীর ছেলে হওয়া সত্ত্বেও সে শেষ পর্যন্ত কাফিরিই রয়ে গিয়েছিল। 

নবী রসূলদের কাজ হচ্ছে হেদায়েত ও সৎপথ প্রদর্শন। বিবি সন্তান সন্তনি কিংবা আপন কওমের ও জাতিকে জবরদস্তি মূলক ভাবে আল্লাহর পথে নিয়ে আনা তাদের দায়িত্ব বা কর্তব্য মোটেই নয়। তোমাকে ওদের উপর বাড়াবাড়ি করার জন্য প্রেরণ করা হয় নি।(সূরা ক্বা-ফঃ আয়াতঃ ৪৫)

তুমি ওদের কর্ম নিয়ন্ত্রা নও। (সূরা গাশিয়াহ ঃ আয়াতঃ২২)

ঐতিহাসিকরা বলেন, তাওরাতে বর্ণিত হয়েছে হযরত নূহ (আ) এর এই ছেলের নাম ছিল কেনআন। কিন্তু মূল ঘটনা বিশেষনের জন্য জরুরী নয় বিধায় পবিত্র কুরআনে ও জাতীয় কোন নামেরই বর্ণনা নেই। 

কিছু প্রাসংগিক বিষয়

(১) নূহের প্লাবন শুধু বিশ্বের একটি বিশেষ অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল, না বিস্তৃত ছিল সমগ্র ভূভাগ? বিশ্বের দীনী ইতিহাস এবং ভূপৃষ্ঠে প্রাপ্ত নিদর্শনাদি থেকে একথা স্পষ্ট প্রমাণিত হয় এই ঘটনা ঐতিহাসিক মর্যাদা রাখে এবং একে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।

তাওরাত ছারাও হিন্দুধর্মের বিভিন্ন গ্রন্থে এর বর্ণনা রয়েছে। ঐ সব গ্রন্থে কুরআনে বর্ণিত সহহ সরল ঘটনাকে কিছুটা জটিল করা হয়েছে বটে, তবে মূল ঘটনাকে পুরাপুরি সমর্থন দেয়া হয়েছে।

মাওলানা সেইয়াদে আবু নরস আহমদ হুসাইন ভুপালী তাঁর তারী খুল আদাবিল হিন্দী বইতে (১) হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন গ্রন্থদিতে যে ভাবে এই ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। তাতে দেখা যায় হিন্দু গ্রন্থাদিতে হযরত নূহ (আ) কে মুন বলা হয়েছে যার অর্থ ইশ্বরের ছেলে বা মনুষ্যজাতির পূর্বপুরুষ।

(২) পবিত্র কুরআনে স্পষ্ট বর্ণনা করা হয়েছে হযরত নূহ (আ) তাঁর জাতি বা কওমে মধ্যে সুদীর্ঘ ৯৫০ বছর তাবলীগ ও দাওয়াতের (আল্লাহ দিকে আহবান) দায়িত্ব পালন করেছিলেন। 

আমি তো নূহকে তাঁর কওমের কাছে প্রেরণ করেছিলা। সে ওদের মধ্যে অবস্থান করেছিল সাড়ে নয়শ বছর। (সূরা আনকাবুতঃ আয়াতঃ১৪)

এ বয়সের পরিমাণ বর্তমান স্বাভাবি বয়সের অনুপাতে অত্যধিক মনে হলেও অসম্ভব বা অবিশ্বাস্য কিছুই নয়। কেননা সৃষ্টির সূচনাকালে ঐ সব দুঃখ কষ্ট, দুশ্চিন্তা ও রোগ ব্যধি মোটেই ততটা ছিল না, যতটা পরবর্তী কয়েক হাজার বছরের মধ্যে মানব সভ্যতার কৃত্রিম উপাদানের কারণে তৈরি হয়েছে। প্রাচীন ইতিহাস এটা স্বীকার করে কয়েক হাজার বছর পূর্বেকার মানুষের স্বাভাবিক বয়সের পরিমাণ বর্তমান কালের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। তাছাড়া হযরত নূহের স্বাভাবিক বয়সের ব্যাপারটি ঐ সব ব্যতিক্রমের শামিল যা নবী রসূলদের ক্ষেত্রে মাও হাবাতে ইলাহী (আল্লাহর বিশেষ অবদান) ও আয়াতুল্লাহ (আল্লাহর বিশেষ নিদর্শন) হিসাবে গণ্য। 

এর হকমত (বিজ্ঞতার দিক) ও গায়ত (উদ্দেশ্য) একমাত্র আল্লাহ তাআলাই ভাল জানেন।

পবিত্র কুরআন কোন নবী রসূলেরই দাওয়াত ও তাবলীগের সময়কাল এত স্পষ্ট ভাবে বর্ণনা করেনি যেমনটি বর্ণনা করেছে হযরত নূহের ক্ষেত্র! অতএব আজ থেকে আনুমানিক সাত হাজার বছর পূর্বেকার এই ঘটনাকে অৎকালীন ঐতিহাসিক সাক্ষ্য প্রমাণের প্রেক্ষিতে যদি সত্য বলে মেনে নেয়া যায় তবে তাতে অসুবিধার কিছুই নেই। আর যদি ঐ সব সাক্ষ্য প্রমাণকে অবাস্তব মনে করা হয় তবে বয়সের ব্যাপারটি এই পটভূমিতে মেনে নেয়া যায় একটি বিশেষ অবস্থার প্রেক্ষিতে এটা ছিল আল্লাহ তাআলার একটি বিশেস অবদান যার দ্বারা হযরত নূহ নবী অনগৃহীত হয়েছিলেন, যেমন পরবর্তীকালে অনুগৃহীত হয়েছেন অপরাপর নবী রসূলগণও তাদের অবস্থা ও পরিবেশ অনুযায়ী বিশেষ বিশেষ অবদান দ্বারা। এ মতামতই সঠিক এবং সত্য। অতএব দুরদূরান্তের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দ্বারা হযরত নূহের বয়সকাল-হ্রাস করার প্রচেষ্টা বাতুল বৈ তো নয়।

বিখ্যাত আরবী কবি আবুল আলা আল মুআররী তার কয়েকটি কবিতায় উল্লেখ করেছে যে, প্রাচীন যুগের লোকেরা সন ও আম (বছর) কে শাহর (মাস) অর্থে ব্যবহার করত। এই হিসাবে কোন কোন ঐতিহসাকি মনে করেন হযরত নূহ (আ) সর্বমোট আশি বৎসর তার সম্প্রদায়ের মধ্যে আল্লাহর দ্বীন প্রচার করেছিলেন। এবং তার সর্বমোট বয়স একশ পঞ্চাশ বছরের বেশি ছিল না।

কিন্তু এই মতবাদ সত্য ভিত্তিক বলে মনে হয় না। আর যদি আবুল আলার কথা সত্য হয়েও থাকে তবে তা নিঃসন্দেহে আরবের কোন অজ্ঞাত অখ্যাত হিসাবের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কেননা কুরআন নাযিল কালে আরবের কোন কওমের মধ্যেই লক্ষ্য করা যায় নি যে তারা সন বা আম (বছর) কে শাহর (মাস) অর্থে ব্যবহার করেছে। অতএব এ ধরনের একটি অমূলক তথ্যের ‍উপর ভিত্তি করে কুরআনী ভাষ্যের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ অবান্তর।

এখানে একটি কথা বিশেষভাবে প্রণিধান যোগ্য কুরআনে যে ভঙ্গিতে উপরোক্ত সময়কালের বর্ণনা করা হয়েছে তাতে স্পষ্ট বুঝা কুরআন হযরত নূহ (আ)-এর অস্বাভাবিক দীর্ঘ তাবলিগী সময়কাল বর্ণনার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে। অণ্যথায় কুরআনের সাধারণ নীতি অনহায়ী একান্ত প্রয়োজন ছাড়া তাতে এধরনের টুঁকিটাকি বিষয়ের বর্ণনা আদৌ থাকে না।

(৩) তাওরাত এবং ইয়াহুদীদের অপরাপর রেওয়ায়েত (বর্ণনা) অনুকরণ করে কোন কোন মুফাসসির বলেছেন, আল্লাহ নূহের প্লাবনের চল্লিশ বছল পূর্ব থেকেই সকল মহিলাকে বন্ধ্যা করে দিয়েছিলেন যাতে তাদের থেকে আর বংশ বিস্তার না ঘটে। কিন্তু এ বর্ণনাটি নেহাত পালগল্প ছাড়া কিছু নয়। খুব সম্ভব এ কাহিনী গড়ার উদ্দেশ্য হলো যাতে নূহের ঘটনার প্রেক্ষিতে এ প্রশ্ন উত্থাপিত না হয়-তবে নূহের প্লাবন কি অপরাধে নিষ্পাপ শিশুদেরও ধ্বংশ করলো?

সতর্কতা অবলম্বনকারী ঐ সব মনীষীরা এক্ষেত্রে আল্লাহর কানুন কি সম্ভবতঃ সে দিকটি চিন্তা গবেষণা করে দেখেন নি।অন্যথায় তাদেরকে এ ধরনের রেওয়াতের পিছনে ছুটতে হত না, যা ইয়াহুদীদের ভ্রান্ত চিন্তা আকায়েদ (ধর্ম বিশ্বাস) থেকে সৃষ্ট।

সৃষ্টি জগতে আল্লাহর এইনিয়ম সচল রয়েছে যখনই রোখ ব্যাধি, মহামারী, প্লাবন ভূমিক্প ইত্যাকার প্রলয়ঙকারী বস্তু প্রার্দুভাব ঘটে-চাই তা শাস্তি হিসাবে ঘটুক অথবা দৈনন্দিন জীবন বহির্ভূত পৃথক কোন কারণের ফলশ্রুতি হিসাবে-যেখানেই এর প্রাদুর্ভাব ঘটবে সেখানকার সকল জীবজন্তু এবং মানুষ-চাই তারা পূণ্যবান হোক অথবা গুনাহগার, আল্লাহর বন্ধু হোক অথবা শয়তান, সৎ ও সাধু হোক অথবা অসৎ দুস্কৃতিকারী অবশ্যই স্বাভাবিক নিয়ম ও কার্যকারণ অনুযায়ী তার দ্বংসের আওতায় আসবে। এতে মানুষে মানুষে বা প্রাণীতে প্রাণীতে কোন ধরনের ব্যতিক্রম দৃষ্টিগোচর হবে না।

অবশ্য আখিরাতের ক্ষেত্রে এতে উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম দৃষ্টিগোচর হবে। অর্থাৎ ফাসিক,ফাজির ও পাপাচরীদের জন্য তা আল্লাহর শাস্তির কারণে এবং পূণ্যবানদের জন্য সৌভাগ্য ও সুউচ্চ মর্তবালাভের কারণে পরিণত হবে।

আমরা কি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে লক্ষ্য করি না যখন ভূমিকম্প আসে তখন নেকী-বদী উভয়ের উপরই সমভাবে তার প্রভাব পড়ে। যখন মহামারীর প্রাদুভার্ব ঘটে তখন সৎ-অসৎ উভয়ই তার দ্বারা আক্রান্ত হয়।

অবশ্য এখানে ম্মতব্য নবী বা রসূলের অনবরত অবাধ্যতার কারণে যখন কোন কওরেম উপর এধরনের শাস্তি আসে তখন নবী বা রসূলকে অহী মারফত পুর্বাহ্নেই এ সম্পর্কে জ্ঞাত করা হয় এবং তাকে এ নির্দেশও দেয়া হয় তিনি যেন ইসলামের ঝান্ডাতলে আশ্রয় গ্রহণকারী তার অনসারীদের নিয়ে সম্ভাব্য শাস্তিযোগ্য ঐ এলাকা থেকে নিরাপদ দূরত্বে গমন করেন। আর তার যাবার সময় কওমের সামনে যেন স্পষ্ট ঘোষণা দিয়ে যান এখন হয় তারা আল্লাহর নির্দেশাদির সামনে মাথা নোয়াবে, নয়ত শাস্তি ভোগ করবে। মোটকথা এ ভাবেই মুমিনরা আল্লাহর শাস্তি থেকে হেফাজত লাভের সুযোগ পান।

অতএব কোন কোন মুফাসসির যে সতর্কতার বশবর্তী হয়ে ইয়াহুদীদের গালগল্পের শরণাপন্ন হয়েছে তাদের সে সতর্কতার মোটেই প্রয়োজন ছিল না।

অতএব বিনা দ্বিধায় বলা যায় নূহের প্লাবনে তার কওরেম স্ত্রী-পুরুষের যুবক বৃদ্ধ, ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সকলেই ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। অতপর বয়ঃপ্রাপ্ত ও বিবেকবুদ্ধি সম্পন্ন যে সকল মানুষ আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করেছিল তাদের ক্ষেত্রে এই শাস্তি চিরন্তন শাস্তিতে পরিণত হবার এবংঅপ্রাপ্ত বয়স্ক ও বিবেকবুদ্ধিহীন যে সকল মানুষ কোন পাপই করে নি তাদের আখিলাতের আযাব থেকে মুক্তি পাবার ব্যাপারটি সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর এখতিয়ারাধীন। আল্লাহর অবারিত ক্ষমা ও নৈকট্য লাভে ধন্য হন।

গুরুত্বপূর্ন ফলাফ

(১) প্রতিটি মানবকেই তার কর্মের জবাবদিহি করতে হয়। এ হেতুই পিতার মাহাত্ম, পুত্রের অবাধ্যতার কিংবা পুত্রের পূণ্য পিতার পাপের বিনিময় হতে পারে না। তাই হযতর নূহের নবুওত, তার পুত্র কেনআনের কুফরীকে ঢেকে দিতে পারেনি কিংবা হযরত ইবরাহীমের উচ্চ মর্যাদা, তাঁর পিতার আযরের পরিত্রাণের হেতু হতে পারেনি। প্রত্যেকেই নিজের প্রকৃতি (খেয়াল খুশী) অনুযায়ী কাজ করে। (সূরা ঃবানী ইসরাঈল,আয়াতঃ৮৪)

(২) সংসর্গ হলাহলের চেয়েও মারাত্মক এবং এর পরিণাম ক্ষতি অপমান, লাঞ্ছনাও ধ্বংস ছাড়া কিছু নয়। পূন্য মানুষের জন্য একটি প্রয়োজনীয় বস্তু। কিন্তু এর চেয়েও প্রয়োজনীয় বস্তু হচ্ছে পুণ্যেবানদের সহবত পাপ থেকে বেঁচে থাকা মানবের জন্য একটি প্রশংসনীয় বৈশিষ্ট্য, কিন্ত কুসংসর্গ থেকে বেঁচে থাকা তার চেয়ে ও অধিক মূল্যবান। সৎসংসর্গ মানুষকে করে, সৎ আর অসৎসংসর্গ করে অসৎ।

(৩) আল্লাহতা‘আলার উপর সঠিক ঈমান ও নির্ভরশীলতার সাথে সাথে বাহ্যিক আসবার সামগ্রীর ব্যবহার তাও ক্কুল আ‘লাল্লাহ (আল্লাহর উপর ভরসা)-এর বিপরীত ধর্মী কোন কাজ নয় বরং তা তাওক্কুল আলাল্লাহরই অনুকূল কর্ম পদ্ধতি। এ হেতু নূহের প্লাবন থেকে বাঁচার জন্য 

(৪) গোনাহ থেকে মাসুম বা হওয়ার সত্ত্বেও আপন মানব সুলভ স্বভাবের হেতু আল্লাহর নবীরও পদস্থলন হতে পারে। তবে আল্লাহর পক্ষ থেকে সতর্ক করে দেয়ার কারণে তিনি শিগগীরই নিজেকে সামলে নিতে সক্ষম হন। হযরত আদম (আ) ও হযরত নূহ (আ) এর ঘটনা এর জ্বলন্ত প্রমাণ। তাছাড়া কোন মানবই অদৃশ্যের খবর রাখেন না, চাই তিনি নবী হোন অথবা অন্য কেউ, যেমন আয়াতে কুরআনী। (সুতরাং যে বিষয়ে তোমার ইলম নেই সে বিষয়ে আমাকে অনুরোধ করো না) দ্বারা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে।

(৫) সবজ্ঞ আল্লাহ তাআলার জ্ঞানচক্ষু সৃষ্টির প্রটিটি প্রান্তে প্রান্তে এবং প্রতিটি পরতে পরতে সর্বক্ষণ কার্যরত রয়েছে বটে, তবে এটা প্রয়োজনীয় নয় যে, প্রতি অপরাধের শাস্তি বা প্রতিটি পুণ্যকর্মের পুরস্কার এই পৃথিবীতে পাওয়া যাবে। কেননা এ পৃথিবী হচ্ছে কর্মক্ষেত্রে, আর কর্মের প্রতিফল ভোগ করার স্থান হচ্ছে মা আদ বা আখিরাত। এতদসত্ত্বেরও সীমালংঘন দাম্ভিকতা ও দুটি দুস্কর্মের শাস্তি কোন না কোন ভাবে এ পৃথিবীতেও ভোগ করতে হয়।

ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) বলেছেন, জালিম ও দাম্ভিক তাদের মৃত্যুর পূর্বেই আপন অত্যাচার ও দাম্ভিকতার কিছু না কিছু শাস্তি অবশ্যই ভোগ করে। অপমান ও লাঞ্ছনার মুখ তাদেরকে অবশ্যই দেখতে হয়। বিভিন্ন যুগে আল্লাহর সত্যিকার নবীদের সাথে যারা বাড়াবাড়ি করেছে এবং ইতিহাসে যারা অত্যাচারি ও দাম্ভিকরুপে কুখ্যাত তাদের অশুভ পরিণাম এবং আতংকজনক ধ্বংসের ঘটনাবলিই উপরোক্ত দাবীর সর্বোৎকৃষ্ট প্রমাণ।

গোপন মাসাআলা

আমাদের ইউটিউব ইউটিব চ্যানেল

Leave a Comment