তাকওয়া কাকে বলে?
12:19:21 12/03/2023
তাকওয়া কাকে বলে? হযরত ওমর (রাঃ) উবাই (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করলেন, তাকওয়া কি? তদুত্তরে তিনি বললেন, তুমি কি কখনও এমন কোন পথ দিয়ে হেটেছ, যেই পথের চতুর্দিকে কাঁটা আর কাঁটা, পাহাড়ের মাঝখানে সরু একটি রাস্তা? ওমর (রাঃ) বললেন হ্যাঁ, এ রকম রাস্তা দিয়ে আমি হেঁটেছি। কি ভাবে হেঁটেছ? ওমর (রাঃ) বললেন অত্যন্ত সতর্ক, আমার কাপড়কে আমি গুছিয়ে নিয়েছি, যাতে আমার আশে পাশের কাটা লেগে না যায়। আমি সামনের দিকে খুবই সতর্ক হলাম যেন আমার পায়ের মধ্যে কোন কাঁটা বিঁধে না যায়। খুবই সতর্ক হয়ে আমি রাস্তা দিয়ে হেঁটেছি, কাটা থেকে বাঁচার জন্য নিজকে আমি খুবই সচেতন ও সতর্ক রেখেছি ।হযরত উবাই বললেন এটাই হচ্ছে তাকওয়া।
যে দুনিয়ার উপর তুমি বাস কর সেটাই হচ্ছে চিক সরু একটি রাস্তা, চারদিকে কাঁটা, শিরকের কাঁটা, কুফুরীর কাঁটা, ঘুষের কাঁটা, যেনার কাঁটা। এত কাঁটার ভিতরে তোমাকে বাস করতে হবে। চাকরী করতে হবে, ব্যবসা করতে হবে, সবকিছু করতে হবে, কিন্তু কাঁটা আর কাঁটা চারদিক। কণ্টকাকীর্ণ রাস্তায় তুমি যেমন সতর্ক অবস্থায় থাক, তোমার শরীরে যেন কাঁটা বিদ্ধ না হয় । একই ভাবে তোমাকে দুনিয়াতে সতর্কাবস্থায় থাকতে হবে । এমন সতর্ক হতে হবে শিরকের কাঁটা, কুফুরীর কাঁটা যাতে পায়ে না লাগে । সুদ-ঘুষের কাঁটা যেন পায়ে না লাগে, সতর্ক ভাবে জীবন পথ পাড়ি দিতে হবে। আল্লাহকে ভয় করে দুনিয়াতে বাস করার নামই হচ্ছে তাকওয়া।
যে ব্যক্তি তাকওয়ার উপর জীবন যাপন করবে তারাই মোত্তাকী । এই দুনিয়াতে বাস করতে হলে শুধু মসজিদে থাকা যাবেনা। এমন নয় যে আমি শুধু আল্লাহ আল্লাহ করব মসজিদ থেকে বের হবনা। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এবাদতের জন্য যেমন মসজিদে আসতে বলেছেন ঠিক তেমনি রিজিকের জন্য বাজারে ময়দানে যেতে বলেছেন। আমাকে লেনদেন করতে বলেছেন, সর্বত্র আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহর হুকুমকে মাথার উপর রাখাকে বলা হয় 'তাক্বওয়া' ।
আমি একজন ব্যবসায়ী, আমি যদি ইচ্ছে করি রমযানে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যগুলো পূর্বে হতে গুদামজাত করে রাখি, তাহলে এক রমজানে আমি কোটি কোটি টাকার মালিক হতে পারি। আমার সামনে বড় ধরনের এক সুযোগ, আমাকে গুদাম জাত করতে হবে । যত পুঁজি আছে সবটুকু বিনিয়োগ করে আমি ষ্টক করলাম । চনা, পিয়াজ, রসুন, মশুর ইত্যাদি গুদামজাত করে রাখলাম । আমার সিন্ডিকেট বাজারের স্বাভাবিক সরবরাহকে বিঘ্নিত করে ফেলল। আমার সামনে বিরাট সুযোগ, একমাসে কোটিপতি হওয়া যাচ্ছে, অনেক টাকার বেনিফিট, বাকী এগার মাসে যা পাওয়া যাবেনা, সেটা রমজান মাসে পাওয়া যেতে পারে।
পবিত্র রমজানের শিক্ষা হল, আমি ব্যবসায়ী, আমার কাছে আল্লাহর নবীর শিক্ষা আছে, আল্লাহর নবী বলেছেন- যে ব্যক্তি গুদামজাত করার কারণে বাজারের সরবরাহকে বিঘ্নিত করে দামকে চড়া করে দেয়, আল্লাহর সাথে সে লোকের কোন সম্পর্ক নেই, সে লোকের সাথে আল্লাহর কোন সম্পর্ক নেই ।” আল্লাহর রাসূল বলেন, যে ব্যক্তি ষ্টক করবে, মুসলমানদের খাদ্যের সংকট সৃষ্টি করবে, আল্লাহপাক তাকে ভয়াবহ দুটি শাস্তি দান করবেন। যথাঃ দারিদ্র ও জটিল রোগ। * মৃত্যুর আগে আল্লাহ পাক এমন রোগ দান করবেন তাকে, যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়না, কঠিন রোগ দিয়ে আল্লাহ তাকে দুনিয়ার বুকে কঠিন শাস্তি দান করবেন এবং তাকে দারিদ্রে নিপাতিত করবেন ।
একদিকে গুদামজাত করলে মোনাফার লোভ, আরেক দিকে আমার ঈমানী চেতনা বলছে, না, আমি গুদামজাত করব আর কোটি টাকার মালিক হব কিন্তু আল্লাহর সাথে আমার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে, আমি এটা হতে দিতে পারিনা। আমার লোভের বিরুদ্ধে আমার অন্তর যদি এ কথা বলতে পারে, তাহলে মনে করতে হবে হ্যাঁ আমার মধ্যে তাকওয়া আছে, আমি মোত্তাকি। আমি কোটি টাকার লোভকে পায়ের নীচে ফেলে দিলাম, আল্লাহকে রাজী করার জন্যে। এটাকে বরা হয় তাকওয়া এবং এই লোককে বলা হয় মোত্তাকী। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকট প্রধানমন্ত্রীর পৃথক কোন মূল্য নেই, প্রেসিডেন্টের দাম নেই, বড় লোকের, বংশীয় মর্যাদার কোন দাম নেই, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সূরায়ে হুজুরাতে বলেছেন-
ان اکرمکم عند الله اتقاكم
আমার কাছে সবচেয়ে বেশী মূল্যবান, সবচেয়ে দামী হল তাকওয়া সমৃদ্ধ ব্যক্তি, সে ব্যক্তি বস্তিবাসী হতে পারে, গরীব হতে পারে কিন্তু তার অন্তরে তাকওয়া আছে, আল্লাহর ভয়ের কারণে সে যদি অন্যায় থেকে বেঁচে থাকতে পারে সে আমার কাছে সবচেয়ে বেশী দামী । আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, তুমি এমন লোককে দেখলে যার চুলের ভাজ ঠিক নেই, কাপড়ে ময়লা, বস্তির মধ্যে থাকে, কোন অনুষ্ঠান হলে কেউ তাকে দাওয়াত দেয়না, সবার সাথে আসন সে পায়না, এই ধরনের লোক তোমরা সমাজের মধ্যে দেখবে, কিন্তু তার মধ্যে মূল্যবান একটি জিনিষ আছে সে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহর ভয়ে সুদ-ঘুষ গ্রহণ করেনা।
অন্যায় করেনা, নামাজ ত্যাগ করেনা, রোযা ত্যাগ করেনা, মনে রাখবে এই ব্যক্তি হাজার মন্ত্রীর চেয়ে মূল্যবান। তাকওয়া ও মোত্তাকী আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয়, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন, আমি তোমাদের কাছে সম্পদ চাইনা, জনবল-ধনবল চাই না, আমি শুধু তোমাদের কাছে চাই গুণী অন্তর ও আমল ।
ان الله لا ينظر الى صوركم وأموالكم ولكن ينظر الى قلوبكم
আল্লাহ তোমাদের বাহ্যিক চাকচিক্য দেখেন না, খুব সুন্দর ফিগার আল্লাহর কাছে প্রিয় নয়, খুব সুন্দর পজিশনের লোক আল্লাহর কাছে প্রিয় নয়, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন- তোমাদের অন্তর হচ্ছে আমার কাছে প্রিয়, যে অন্তরে তাকওয়া আছে।" রমজানের উদ্দেশ্য হচ্ছে তাকওয়া অর্জন করা, এমন তাকওয়া, এমন স্প্রিট, এমন পাওয়ার যে পাওয়ারের কারণে মনের যত লোভ- লালসা সবকিছুকে পায়ের তলায় দেয়া যায়, তা হোক ব্যবসার ক্ষেত্রে, কাজ কর্মের ক্ষেত্রে, লেন-দেনের ক্ষেত্রে।
আপনি কাস্টমসে চাকরি করেন, সরকারের যত আয়, এই আয়ের ৭০% আপনার পকেটে ঢুকানোর সুযোগ আপনার আছে, বন্দর এবং কাস্টমসের মধ্যে সরকারে আয়ের ৭০% পকেটে পকেটে যায় আর ৩০% সরকারি কোষাগারে যায়। আপনি ইচ্ছা করলে অনেক বাড়ী গাড়ীর মালিক হতে পারেন, মানুষের সম্মান কুড়াতে পারেন, এই সিয়াম যদি বাস্তবে আপনার কাছে আসে, আপনার অন্তর তৈরী করে, আপনি বলবেন, আমি বিশাল বাড়ী তৈরী করব চিরস্থায়ী ভাবে ।
আমরা সে বাড়ীতে থাকতে পারবনা । কবরের মধ্যে যখন আমাকে শায়িত করে দেয়া হবে হাত দুটি থাকবে সোজা, খালি হাতে অন্ধকার কবরে যেতে হবে। বিশাল বিশাল বাড়ী আমি কি করে নেব? বারো কোটি মানুষের কোটি কোটি টাকা যে আমি আত্মসাৎ করলাম তার হিসাব কি করে দিব? এ ভয় যদি অর্জন করা যায় এটা হবে প্রকৃত তাওয়া ।