অ্যাপেনডিসাইটিসের কারণ ও লক্ষণ - Appendicitis causes and symptoms
06:57:24 12/11/2023
অ্যাপেনডিসাইটিসের কারণ ও লক্ষণ : শরীরের ছোট্ট একটি অঙ্গ যে মানুষের জীবনটাকে কতটা বিপজ্জনক করে তুলতে পারে, তার উদাহরণ ভারমিফরম অ্যাপেনডিক্স। বৃহদন্ত্রের সিকাম-এর গা থেকে ঝুলে থাকা এ অঙ্গটি দেখতে কৃমির মতো। লম্বায় সাড়ে ৭ সেন্টিমিটার থেকে ১০ সেন্টিমিটার। এক সময়ে এটাকে শরীরের অপ্রয়োজনীয় অঙ্গ মনে করা হলেও পরবর্তীতে প্রমাণিত হয় যে অ্যাপেনডিক্স শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থারই একটি অংশ, যা অস্ত্রের ভেতর এন্টিবডি নিঃসৃত করে জীবাণুকে ধ্বংস করে। যদি কোনো কারণে অ্যাপেনডিক্স-এর সরু পথটি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে ভয়ানক প্রদাহ হয় এবং সেটা ফুলে যায়। অ্যাপেনডিক্স-এর এই প্রদাহকে মেডিক্যাল পরিভাষায় বলে অ্যাপেনডিসাইটিস।
মূলত ১৮৮৬ সালে আমেরিকার বোস্টন শহরের চিকিৎসক আর এইচ ফিজ তার গবেষণায় দেখলেন যে ছোট্ট উপাঙ্গ অ্যাপেনডিক্স যত ঝামেলার কারণ। এ সমস্যার উৎস হিসেবে তিনি প্রথম ভারনিফর্ম অ্যাপেনডিক্স-কে চিহ্নিত করেন। এর ঠিক দু'বছর পর চিকিৎসকরা প্রদাহগ্রস্ত অ্যাপেনডিক্স অপসারণ করতে সক্ষম হন। অ্যাপেনডিসাইটিস এখন একটি পরিচিত শব্দ। অথচ এক সময়ে এ রোগটির কারণে মানুষ মারা যেত। জানতেও পারত না কিসের জন্য প্রাণপাত হলো তার। চিকিৎসকরাও বুঝতে পারতেন না মূল ঘটনা। এখন অ্যাপেনডিসাইটিসে আক্রান্ত রোগীর দ্রুত অপারেশনের ফলে মৃত্যুর হার তেমন একটা নেই বললেই চলে ।
অ্যাপেনডিসাইটিসের কারণ
জীবন যাপনের সাথে অ্যপেনডিসাইটিসের সম্পর্ক রয়েছে। এশিয়া, আফ্রিকা কিংবা পলিনেশীয়দের চেয়ে ইউরোপ, আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়ার অধিবাসীরা অ্যাপেনডিসাইটিসে আক্রান্ত হয় বেশি। এক সময়ে অ্যাপেনডিসাইটিসকে ঠাট্টা করে বলা হতো ধনীদের রোগ। সম্ভবত দৈনন্দিন জীবন যাপন প্রণালী ও খাদ্যাভাসের সাথে সম্পর্ক থাকার কারণে এই বিশেষণটি প্রয়োগ করা হতো, কেননা অতিক্রিয়াজাত বা অতিশোধিত খাদ্য গ্রহণ, খাদ্যে প্রতিদিন মাংসের উপস্থিতির পাশাপাশি শাক সবজির স্বল্পতা অ্যাপেনডিসাইটিসের সহায়ক উপকরণ। দৈনন্দিন কোষ্ঠকাঠিন্যের সাথেও রয়েছে এর নিবিড় সম্পর্ক। আমাদের দেশে উচ্চবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্তের মধ্যে এ রোগের প্রবণতা বেশি। অবশ্য অ্যাপেনডিসাইটিস মূলত অ্যাপেনডিক্স-এ জীবাণু সংক্রমণের ফল।
কোনো কারণে অ্যাপেনডিক্স-এর মুখ বা নালি বন্ধ হয়ে গেলে জীবাণু সংক্রমণের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। শক্ত পায়খানা, কাঁকর খাদ্যকণা, মরিচের বিচি, কৃমি বা অন্য যে কোনো বস্তু খাদ্যনালি বেয়ে সিকামের মধ্য দিয়ে অ্যাপেনডিক্স এর মুখ বন্ধ করে দিতে পারে। তখন শুরু হয় বন্ধ সুড়ঙ্গে জীবাণু সংক্রমণের বিপজ্জনক ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া। যে কোনো বয়সে অ্যাপেনডিসাইটিস হতে পারে। তবে কম বয়সীদের মধ্যে বিশেষ করে যাদের কোষ্ঠকাঠিন্যের প্রবণতা রয়েছে তাদের মধ্যে রোগটি সচরাচর বেশি পরিলক্ষিত হয়।
রোগের উপসর্গ
প্রধান উপসর্গ বাধা। পেটের মাঝ রেখা বরাবর নাভির ওপরে বা সামান্য নিচে অথবা নাভির চারপাশে রোগী চিনচিনে ব্যথা অনুভব করে। ১২ ঘণ্টার মধ্যে ব্যথা তলপেটের ডানদিকে এসে স্থির হয়। হাঁটতে গেলে কিংবা কাশি দিলে ব্যথাটা অসহ্য লাগে। কখনো কখনো নাভির চারপাশে ব্যথা না উঠেও তলপেটের ডানদিকে ব্যথা হতে পারে এবং সেখানেই স্থির থাকে। ব্যথাটা তীব্র হতে পারে, নাও পারে। ব্যথার সাথে রোগীর বমি বমি ভাব হয়, রোগী ২/৩ বার বমিও করে ফেলে। কোনো কোনো রোগীর কোষ্ঠকাঠিন্য থাকে, আবার কারো কারো থাকে ডায়রিয়া। রোগীর দেহে স্বল্পমাত্রার তাপ থাকবেই। জ্বরের মাত্রা সাধারণত ৩৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নিচে থাকে)।
যদি তাপমাত্রা বেড়ে যায় কিংবা রোগীর খিঁচুনি ওঠে বুঝতে হবে অবস্থা আশংকাজনক। রোগীকে পরীক্ষা করলে তলপেটের ডানদিকে একটি বিশেষ জায়গা (MC Burney's point) চাপ দিলে রোগী ব্যথায় কাতরে উঠবে। রক্ত পরীক্ষায় শ্বেত কণিকার সংখ্যাধিক্য থাকে (১০ হাজার থেকে ২০ হাজার / প্রতি মাইক্রো লিটারে), সেই সাথে পাওয়া যাবে নিউট্রোফিলের সংখ্যাধিক্য।
অ্যাপেনডিসাইটিসের সাথে অন্য যেসব রোগের উপসর্গের মিল আছে অনেক রোগ আছে যার কিছু উপসর্গের সাথে অ্যাপেনডিসাইটিসের উপসর্গের মিল রয়েছে। তাই অ্যাপেনডিসাইটিস রোগটি নির্ণয় করার আগে নিশ্চিত হতে হবে যে রোগটি অ্যাপেনডিসাইটিস কি না। বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে ভুলটি বেশি হয়। তাদের বিশেষ কিছু অঙ্গ রয়েছে যেখানে প্রদাহ হলে তাকে অ্যাপেনডিসাইটিস বলে ভুল হতে পারে। যেমন-
একিউট সালফিনজাইটিস : এটা হলো ডিম্বনালির তীব্র প্রদাহ। মেয়েদের মাসিক শেষ হবার ৬-৭ দিন পর সাধারণত ব্যথাটা শুরু হয়। তলপেটের দু'পাশেই ব্যথা হতে পারে, কিন্তু ব্যথাটা যদি শুধু ডান পাশে হয় তবে সেটাকে অ্যাপেনডিক্স-এর ব্যথা বললে ভুল হতে পারে। রাচারড ওভারিয়ান ফলিকল : মাসিক চক্রের ১৪ থেকে ১৬ দিনের মধ্যে এটা ঘটে, বিশেষ করে তরুণীদের মধ্যে এটা পরিলক্ষিত হয় বেশি। এ সময়ে ওভাম বা ডিম্বাণু ফেটে যায়, ব্যথাটা যদি একটু বেশি ও ডান পাশে হয় তাহলে অ্যাপেনডিসাইটিস থেকে পৃথক করাটা খুব কঠিন হয়ে পড়ে।
টুইস্টেড ওভারিয়ান সিস্ট: ডিম্বকোষে সিস্ট থাকলে এবং তাতে প্যাঁচ খেয়ে গেলে তলপেটে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। রোগী বিছানায় গড়াগড়ি করে। ব্যথাটা ডান পাশে হলে তাকে অ্যাপেনডিসাইটিস থেকে পৃথক করা কঠিন হয়। আলট্রাসনোগ্রাম না করা পর্যন্ত রোগ নির্ণয় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
টিউবার প্রেগন্যান্সি : ডান পাশের ডিম্বনালিতে গর্ভ সঞ্চার ঘটলে অ্যাপেনডিক্স-এর ব্যথার মতো তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়। এসব ক্ষেত্রে আলট্রাসনোগ্রাম করাটা অবশ্য করণীয়।
প্রস্রাবের নালিতে সংক্রমণ : নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই এটা ঘটতে পারে। তবে পুরুষদের তুলনায় মেয়েদের ক্ষেত্রে বেশি পরিলক্ষিত হয়। এক্ষেত্রে প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া থাকে বলে রোগ নির্ণয় সহজ হয়। তাছাড়া তলপেটে ব্যথা থাকলেও অ্যাপেনডিক্স-এর ব্যথা থেকে একে পৃথক করা যায়।
এসব ছাড়া অন্য যে সকল রোগকে অ্যাপেনডিক্স-এর ব্যথা বলে ভুল হতে পারে, তার মধ্যে রয়েছে পেপটিক আলসারে অস্ত্র ফুটো হওয়া, পিত্তথলিতে তীব্র প্রদাহ, ম্যাসেনটারিক লিম্ফ অ্যাডেনাইটিস, গ্যাস্ট্রো-এনটেরাইটিস, ডাইবারটি-কুলাইটিস প্রভৃতি।
অ্যাপেনডিসাইটিসের জটিলতা
অ্যাপেনডিসাইটিসে আক্রান্ত হলে এবং তাৎক্ষণিক অপারেশন না করালে বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিতে পারে। যেমন-
অ্যাপেনডিক্স-এ লাম্প বা চাকা হওয়া : সাধারণত অ্যাপেনডিসাইটিস-এ আক্রান্ত হবার ৩ দিন পর চাকা তৈরি হয়। অ্যাপেনডিক্স-এর সংক্রমণ যাতে ছড়াতে না পারে সেজন্য শরীরের মধ্যকার পেটের পর্দা এবং অস্ত্র চারদিক দিয়ে অ্যাপেনডিক্স-কে ঘিরে ফেলে, ফলে চাকা তৈরি হয়। এক্ষেত্রে রোগীকে অপারেশন করা হয় না। এন্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসার প্রায় ৩ মাস পর অপারেশন করা হয়।
অ্যাপেনডিক্স ফেটে যাওয়া : এটি রোগীর জন্য অত্যন্ত সংকটাপন্ন অবস্থা। অবস্ট্রাকটিভ ধরনের অ্যাপেনডিসাইটিস হলে ১২ থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রোগীর অ্যাপেনডিক্স ফেটে যেতে পারে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রোগীকে অপারেশন করতে হবে। নইলে রোগী মারা যেতে পারে।
অ্যাপেনডিক্স-এ গ্যাংগ্রিন হওয়া : তীব্র অ্যাপেনডিসাইটিসের ক্ষেত্রে অ্যাপেনডিক্স-এ গ্যাংগ্রিন বা পচন ধরতে পারে। ইনফেকশন বা সংক্রমণের জন্য অ্যাপেনডিক্স-এর রক্ত চলাচলের শিরাগুলো বন্ধ হয়ে যাবার ফলে পচন শুরু হয়। তাড়াতাড়ি রোগীকে অপারেশন না করলে রোগী মারা যেতে পারে।অ্যাপেনডিক্স-এ পুঁজ হওয়া : অ্যাপেনডিসাইটিসে আক্রান্ত হলে যদি অপারেশনে বিলম্ব বা ব্যথা শুরুর সাথে সাথে ঠিকমতো এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা না হয় তাহলে অ্যাপেনডিক্স-এ পুঁজ হতে পারে। তখন অ্যাপেনডিক্স ফেটে যায়। অপারেশন করে রোগীর অবস্থা ভালো করা হয়। সেপটিসেমিয়া : এ ক্ষেত্রে অ্যাপেনডিক্স-এর ইনফেকশন রক্তে ছড়িয়ে যায়। তখন মারাত্মক জটিলতা দেখা দেয়। রোগী মারা যেতে পারে।
রিকারেন্ট অ্যাপেনডিসাইটিস : এ ক্ষেত্রে রোগী একবার অ্যাপেনডিসাইটিসে আক্রান্ত হলে এবং অপারেশন করিয়ে না নেয়া পর্যন্ত বার বার অ্যাপেনডিসাইটিসে রোগী আক্রান্ত হতে পারে।
অ্যাপেনডিসাইটিসের চিকিৎসা
অ্যাপেনডিসাইটিস রোগের একমাত্র চিকিৎসা হলো অপারেশন করে অ্যাপেনডিক্স ফেলে দেয়া। যদি রোগ নির্ণয় ১০০% নিশ্চিত নাও করা যায়, তবু অপারেশন করলে কোনো ক্ষতি হয় না। কারণ অ্যাপেনডিক্স-এর অপারেশনের ঝুঁকি খুবই কম। বরং অপারেশনটি না করালে, রোগটি যদি সত্যিই অ্যাপেনডিসাইটিস হয়ে থাকে তাহলে মৃত্যু ঝুঁকিও থেকে যায়।