রোযার ঐতিহাসিক পর্যালোচনা - Historical Review of Fasting
10:48:32 12/03/2023
রোযার ঐতিহাসিক পর্যালোচনা - Historical Review of Fasting
হে ঈমানদারগণ! তোমাদের জন্য আমার নিম্নের এই ঘোষণা-
يا ايها الذين آمنوا كتب عليكم الصيام
“তোমাদের উপর সিয়ামকে ফরজ করে দেয়া হয়েছে। সিয়াম মানে রোযা। রোযা শব্দটি ফার্সি । কোরআন ও হাদীসের পরিভাষায় এটাকে বলা হয় সাওম বা সিয়াম। এজন্য রোযা শব্দ ব্যবহারের চেয়েও বরকতময় শব্দ হল সিয়াম। রোযা হল ফার্সি ভাষা। তবে ভাল হল কুরআন এবং সুন্নায় যে শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে তা ব্যবহার করা ।
পবিত্র কুরআনে নামাযকে সালাত বলা হয়েছে এবং রোযাকে সিয়াম বলা হয়েছে । সিয়াম অর্থ হচ্ছে বিরত থাকা । আল্লাহর হুকুম পালন করার নিমিত্তে পানাহার ত্যাগ করা, স্ত্রী সম্ভোগ ত্যাগ করাকে শরীয়তের পরিভাষায় সিয়াম বলা হয়। সুবহে সাদেক থেকে আরম্ভ করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খাওয়া-দাওয়া, পানাহার এবং স্ত্রী সম্ভোগ, যৌনাচার বর্জন করতে হবে নিয়ত সহকারে । আল্লাহ পাক বলেন, তোমাদের জন্য আমি সিয়ামকে ফরজ করেছি। রোযা শুধু ইসলাম ধর্মে
ফরজ নয়, আল্লাহ পাক বলেন,
كما كتب على الذين من قبلكم
“ইতোপূর্বে তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর যেমন রোযা ফরজ করা হয়েছিল। আল্লাহ পাক যত নবী-রাসূল দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন, সবার উপর সিয়ামকে ফরজ করা হয়েছে । তোমাদের উপর ফরজ করা হয়েছে, আগের জাতিদের উপরও সিয়াম ফরজ করা হয়েছে । আসমানি যত ধর্ম ছিল যথা: ইহুদী ধর্ম, খ্রীষ্টান ধর্ম, ইব্রাহীম (আঃ) এর ধর্ম সব ধর্মে সিয়াম সাধনা ছিল ফরজ। কম্পারেটিভ রিলিজিয়ান (Comparative Religion) তথা তুলনা মূলক ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কে যাদের জ্ঞান আছে তারা জানেন, প্রাচীন সব ধর্মে রোযা পালন, পানাহার ত্যাগ ইত্যাদির প্রচলন ছিল । যথা : হিন্দু ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম, জৈন ধর্ম, ব্যবলনীয় ধর্ম, মিশরীয় ধর্ম, এবং মেক্সিকো আদিবাসীর ধর্ম সকল ধর্মে দেখা যায়, পানাহার ত্যাগ করা ও যৌন সম্ভোগ ত্যাগ করার নির্দেশ পালন করা হত । তাহলে ঐ ধর্ম এবং অন্যান্য সকল ধর্মে রোযার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় ।
তবে পৃথিবীর ইতিহাসে আমার জানা ও গবেষণা মতে একটি মাত্র ধর্ম পানাহার কিংবা সিয়াম সাধনাকে অবৈধ মনে করে । সেটা হচ্ছে পারস্যের জরাতুষ্ট ধর্ম । এ ধর্মের দর্শন হল, মানুষ কষ্ট করে চাষাবাদ করবে, পশু পাখি লালন-পালন করবে, কেন সে তার পরিশ্রম লব্ধ সামগ্রী ভোগ থেকে বিরত থাকে, এগুলোর ভোগ থেকে বিরত থাকা যাবেনা, পানাহার ত্যাগ করা যাবেনা । সিয়াম সাধনার কথা তাদের ধর্মে নেই । এরা মনে করে এটা অবৈধ। এই ধর্ম ছাড়া সব ধর্মে সিয়াম সাধনার কথা উল্লেখ আছে। আল্লাহ পাক সে দিকে ইঙ্গিত করে বলেন যে, সিয়াম শুধু তোমাদের জন্য নয়, প্রত্যেক জাতির ধর্মে এটা বাধ্যতামূলক ছিল ।
উইল গোরা একজন ইংরেজ ঐতিহাসিক তিনি মেক্সিকোর আদিবাসীদের যে সিয়াম সাধনার কথা লিখেছেন, সেখানে দেখা যায় যে, তাদের ধর্মে একজন লোক যদি দেবতা হতে চায়, ধর্মের দিক থেকে অনেক বড় হতে চায়, কঠোরভাবে পানাহার ত্যাগ করতে হবে। জিহ্বার গোড়াতে ছিদ্র করে একটি শলা সেখানে ডুকিয়ে দিতে হবে, যাতে বাইর থেকে তার মুখটা বন্ধ থাকে । পানাহার বন্ধ, আনুষ্ঠানিক ভাবে বন্ধ, ইচ্ছা করলেও খেতে পারবেনা। এবাবে পানাহার ত্যাগ করে কেউ যদি ১৬০ দিন সাধনা করতে পারে তাহলে সে দেবতা হতে পারবে, এটা হচ্ছে মেক্সিকোর আদিবাসীদের ধর্মীয় বিশ্বাস।
যদি ১৬০ দিন পর্যন্ত টিকতে না পারে, যদি খুলে ফেলে তাহলে পরের বছর তাকে আবার চেষ্টা করতে হবে। তাদের ধর্ম মতে এই নির্দেশ হল তাদের জন্য যারা পাদ্রী, দেবতা সাধারণ মানুষের জন্য এক ধরনের সিয়াম সাধনা আছে, যেটাকে তারা বলে স্মানিমুক্ । সূর্যাস্তের সাথে সাথে খাবার বন্ধ, পানাহার বন্ধ । আগামীকাল যদি ঝকঝকে সূর্য দেখা যায় অর্থাৎ আকাশে যদি কিরণ সহ সূর্য উদয় হয় তখন পানাহার করতে পারবে। যদি এমন হয় যে, আগামীকাল সূর্য উদিত হয়েছে ঠিকই কিন্তু মেঘের কারণে আলো দেখা গেলনা, তাহলে তখন পুরা দিন পানাহার ত্যাগ করে থাকতে হবে। এভাবে যদি এক সপ্তাহেও আকাশে সুর্য দেখা না যায় তাহলেও পানাহার করা যাবেনা, এটাকে তারা স্নানিমুক উপবাস বলে । এভাবে প্রাচীন মেক্সিকোর আদিবাসীরা তাদের রোযা পালন করত।
ভারত বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের চেয়ারম্যান হিন্দু ধর্মমত সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন, হিন্দু ব্রাহ্মণদের এক বছরে তাদের নিয়ম অনুযায়ী বিভিন্ন উপলক্ষে বিভিন্ন পূজা-পার্বনে তাদেরকে উপবাস করতে হয়। বার্ষিক রোযার সংখ্যা হল চব্বিশ। বৌদ্ধ ধর্মের যিনি উদ্ভাবক বৌদ্ধদের ছয় বছর পর্যন্ত তিনি সিয়াম সাধনা করেছেন। বৌদ্ধদের সম্পর্কে অনেকের মতামত আছে যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বিভিন্ন জাতির কাছে যে সব নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন তাদের মধ্যে পঁচিশ জনের নাম কুরআন ও হাদীসে উল্লেখ আছে। আল্লাহ বলেন-
منهم من قصصناهم عليك ومنهم من لم نقصص هم علیک
আমি এত সংখ্যক নবী-রাসূল প্রেরণ করেছি তাদের কারো কারো কথা আপনার কাছে পেশ করেছি এবং এমন নবী- -রাসূলও পৃথিবীর বুকে ছিল যাদের নাম আমি আপনাকে বলিনি। এজন্য অনেক মুসলিম পন্ডিতরা বলেন, বৌদ্ধদের যে ঘটনাবলী আমরা পাই, তার আলোকে বুঝা যায় তিনিও একজন আল্লাহর নবী হতে পারেন। তবে এর সপক্ষে কোন অকাট্য প্রমাণ নেই । আল্লাহ কোরআনে বৌদ্ধদেবের নাম বলেননি। কিংবা হাদীসে তার নাম আসেনি। এ জন্য আমরা অকাট্যভাবে বলতে পারিনা যে তিনিও একজন আল্লাহর প্রেরিত নবী ছিলেন। তার সাধনা, তার মতামত, তার বক্তব্য এবং কথাবার্তার আলোকে অনুমান করা যায়, তিনিও একজন ওহী প্রাপ্ত আল্লাহর নবী হতে পারেন । একজন রাজার পুত্র হয়েও ভোগ বিলাসকে ত্যাগ করে তিনি ছয় বছর পর্যন্ত সিয়াম সাধনার লিপ্ত ছিলেন। এমন দিনও গিয়েছে যে, পুরা দিনে তার পেটে মাত্র একটি দানা পড়েছে ।