তাবুক যুদ্ধের ইতিহাস
তাবুক যুদ্ধের ইতিহাস
মহানবী সা. তায়েফ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর ৯ম হিজরীর অর্ধেক পর্যন্ত মদীনায় অবস্থান করেন। অতঃপর তিনি অবগত হলেন যে, মুতা যুদ্ধে পরাজিত রূম বাহিনী মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য তাবুক নামক স্থানে (যা মদীনা থেকে চৌদ্দ মনযিল দূরে অবস্থিত) অনেক কিছু প্রস্তুত করে রেখেছে। রাসূলুল্লাহ সা.ও জিহাদের প্রস্তুতি নিলেন। কিন্তু সে সময় মুসলমানগণ দুর্ভিক্ষের কারণে অত্যন্ত সংকীর্ণ হাত ও অভাব-অনটনের মধ্যে ছিলেন। এছাড়া প্রচণ্ড গরম পড়তেছিল। কিন্তু প্রাণোৎসর্গকারী দল ছিল। ইহা সত্ত্বেও যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে লাগলেন। চাঁদা তোলা হল। হযরত সিদ্দিকে আকবার রা. ঘরের যাবতীয় আসবাব নিয়ে এলেন। হযরত উসমান গনী রা. যুদ্ধের উপকরণ ইত্যাদি বিশাল আকারের সাহায্য উপস্থিত করলেন। যা নয় শত উট এবং এক শত ঘোড়া ছিল ।
সাস্থসম্মত উপায়ে তৈরি ১০০%-খাঁটি-ঘি
রজব মাসে বৃহস্পতিবার দিন মহানবী সা. ত্রিশ হাজার সাহাবীর একটি বাহিনী নিয়ে তাবুকের দিকে অগ্রসর হলেন।
কিছু মু'জেযা: রাস্তায় হযরত আবু যর গেফারী রা. কে দেখলেন। তিনি সবার থেকে পৃথক হয়ে চলছেন। তখন মহানবী সা. ইরশাদ করলেন, এ ব্যক্তি দুনিয়া থেকে আলাদাই চলবে, আলাদা জীবন যাপন করবে এবং আলাদাই মৃত্যুবরণ করবে। সুতরাং তাই হল ।
এই যুদ্ধে মহানবী সা. এর উটনী হারিয়ে যায়। মহানবী সা. কে ওহীর মাধ্যমে বলা হল, উটনীর লাগাম অমুক জায়গায় গাছের সাথে পেঁচিয়ে গেছে। সেখানে গিয়ে দেখা গেল সে অবস্থাই হয়েছে। [মুগলতাঈ পৃ ৭৭]
যখন মহানবী সা.পৌঁছলেন তো সেখানে কেউ ছিল না। বাদশাহ হিরাক্লয়াস হিমসে চলে গিয়েছিল। মহানবী সা. হযরত খালিদ রা. কে উকায়দার খৃষ্টানের নিকট প্রেরণ করলেন এবং তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করলেন,তার সাথে তোমাদের রাতে দেখা হবে যখন সে শিকার করতে থাকবে। হযরত খালিদ রা.পৌঁছলে হুবহু এই ঘটনা সামনে আসল। তিনি তাকে গ্রেফতার করে আনেন।
মোটকথা: তিনি সেখানে পনের বিশ দিন অবস্থান করেন। কিন্তু কেউ মোকাবালার জন্য আসেনি। প্রত্যাবর্তনের ইচ্ছা করলেন। এটাই মহানবী সা. এর শেষ যুদ্ধ । ৯ম হিজরীর রমযানুল মুবারকে তিনি মদীনায় ফিরে আসেন।
মসজিদে যিরারে অগ্নি সংযোগ: প্রত্যাবর্তনের পর মহানবী সা. ঐ স্থানে আগুন লাগানোর নির্দেশ দিলেন, যা মুনাফিকরা মুসলমানদের বিরূদ্ধে পরামর্শ করার জন্য মসজিদের নামে তৈরী করেছিল এবং মুসলমানদের ধোঁকা দেয়ার জন্য ইহার মসজিদ নাম দিয়েছিল। (মুগলতাঈ)
এতে একথা জানা গেল যে, মূলত মসজিদে যেরার কোন মসজিদ ছিল না। বিভিন্ন প্রতিনিধি দলের আগমন এবং দলে দলে ইসলামে প্রবেশ হুদায়বিয়া সন্ধির পর যখন রাস্তা নিরাপদ হল। তখন ইসলাম প্রচার (যার নিরাপত্তারই প্রয়োজন ছিল) এক পর্যায়ে বেশ ব্যাপক আকারে শুরু হল। আর একারণেই আসমানী দফতরে ইহাকে বিজয় করে নাম রাখা হয়। কিন্তু তারপরেও কিছু লোক কুরাইশদের চাপে ইসলামে প্রবেশ করতে পারছিল না। মক্কা বিজয় ইহাকেও পরিসমাপ্তি ঘটাল।
এখন কুরআনে কারীম সমস্ত আরবের প্রতিটি গৃহে পৌঁছে স্বীয় অলৌকিকতার মাধ্যমে সকলের হৃদয়ের উপর আসন গেড়ে বসল। যার ফল এই হল যে, ঐসব লোকই যারা কোন ভাবেই ইসলাম এবং মুসলমানদের আকৃতি দেখতে চাইত না, আজ দলে দলে মহানবী সা. এর খেদমতে দূরদূরান্ত সফর করে প্রতিনিধি দলের আকারে আসছে। সন্তুষ্টি ও আগ্রহের সাথে ইসলামের ছায়াতলে নিজের জান ও মাল কুরবানী করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে এই প্রতিনিধি দলের অধিকাংশই ৯ম হিজরীতে মহানবী সা. এর দরবারে উপস্থিত হয়।
সাকিফ গোত্রের প্রতিনিধি দল: নবীজী সা. তবুক থেকে প্রত্যাবর্তনের পরই সাকিফ গোত্রের প্রতিনিধি দল মদীনা তায়্যিবায় উপস্থিত হয়ে ইসলামে দিক্ষিত হল । অতঃপর ধারাবাকিভাবে প্রতিনিধি দল আসতে লাগল । যাদের সংখ্যা প্রায় সত্তর বর্ণনা করা হয়।
তাদের মধ্য হতে কারো কারো সংক্ষিপ্ত ঘটনা এই
বনী ফাযারার প্রতিনিধি: তারা আগেই মুসলমান হয়ে মহানবী সা. এর খেদমতে উপস্থিত হয়।
বনী তামীমের প্রতিনিধি: তারা মহানবী সা. এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে কিছু কথা বলার পর সকলেই মুসলমান হয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে।
সাআদ বিন বকরের প্রতিনিধি দল: এই প্রতিনিধি দলের আমীর যমাম ইবনে সা'লাবা ছিলেন। তিনি মহানবী সা.এর কাছে অনেকগুলো প্রশ্ন করেন। মহানবী সা. প্রত্যেকটির সান্ত্বনামূলক উত্তর দিলেন। ধর্মের পরিপূর্ণ যাচাই এবং বক্ষ উন্মোচন হবার পর ইসলামে দিক্ষীত হয়ে নিজ গোত্রে প্রত্যাবর্তন করেন এবং স্বগোত্রে তাবলীগ করলেন। যার ফলে তার সমস্ত সম্প্রদায় ইসলাম গ্রহণ করে।
কিন্দার প্রতিনিধি দল: সূরা সাফ্ফাতের প্রাথমিক আয়াতগুলো শোনা মাত্রই তাদের হৃদয়ে ইসলাম আসন গেড়ে বসে।
বনী আব্দে কাইসের প্রতিনিধি দল: তারা প্রথমে খৃষ্টান ছিল। সকলেই মহানবী সা. এর দরবারে উপস্থিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করে সৌভাগ্যশীল হল। তিনি তাদেরকে ইসলামের জরুরী বিষয়গুলো শিক্ষা দিলেন।
বনী হানিফার প্রতিনিধি দল: এরাও মহানবী সা. এর কাছে উপস্থিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করল । তাদের মধ্যে মুসাইলামাও ছিল। পরবর্তীকালে নবুওয়াতের দাবী করলে তাকে মুসাইলামা কাজ্জাব নামে ডাকা হত। শুধু তার নবুওয়াতের দাবীর প্ররিপ্রেক্ষিতে সিদ্দিকে আকবরের যুগে সাহাবীদের হাতে সে তার সমস্ত অনুসারীসহ নিহত হয়।
উপকারিতা: মুসাইলামাতুল কাজ্জাব নবুওয়াতের দাবীর সময়ও মহানবী সা., কুরআন ও ইসলামকে অস্বীকার করেনি। ইমামুল হাদীস ওয়াত তাফসীর শায়খ আবু জা'ফর তাবারী তার বিখ্যাত কিতাব 'তারিখে' লিখেন, মুসাইলামা নিজের মুয়ায্যিনকে আদেশ করেছিল যে, আযানে বরাবরই আশহাদু আন্না মুহাম্মদার রাসূলাল্লাহ বলবে। কিন্তু যেহেতু মহানবী সা. এর নবুওয়াতের পর কোন প্রকারের নবুওয়াতের দাবী জায়েয নেই; বরং নবুওয়াতের দাবী করাটাই অনেক নস, হাদিসে মুতাওয়াতির এবং সর্বজনস্বীকৃত আক্বীদায় খতমে নবুওয়াতের আকীদাকে অস্বীকার করা হয়। এজন্য সাহাবীদের ইজমা হল মুসাইলামার শরীয়তবিহীন নবুওয়াতের দাবী করা কুফর এবং ধর্মহীনতা। সাহাবীদের সর্বসম্মতি মতে তাদের বিরু দ্ধে জিহাদ করা হয়েছে। তাদের আযান, নামায, তিলাওয়াতে কুরআন তাদেরকে কাফের বলা থেকে বিরত রাখতে পারেনি।
মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর নবুওয়াতের দাবী মুসাইলামার দাবী অপেক্ষা জঘন্যতম। তার অপরাধ শুধু এই নয় যে, সে নিজেকে অন্যান্য সকল নবীর চেয়ে উত্তম বলে; বরং অনেক নবীর ব্যাপারে এমন অশালীন ও অবমাননাকর মন্তব্য করেছে যে, কোন সাধারণ ভদ্র মানুষের দ্বারা তা সম্ভব নয়। বিশেষ করে হযরত ঈসা আ. এর উপর নিজের তরকশ (বাণাধার) খালী করে এমন বাজারী গালি দিয়েছে, যা শুনে কোন মুসলমান কোনভাবে ধৈর্য ধারণ করতে পারে না। । এ সব কথার সত্যতা স্বয়ং তার রচিত “যমীমায়ে আঞ্জামে আতহাম, দাফেউল বালা ও নুযুলে মসীহ ইত্যাদি বই- পুস্তক দ্বারা সকলেই যাচাই করতে পারে। এসব এবং এ জাতীয় আরো অসংখ্য শিরকি দাবী দেখে সকল ইসলামী দল ও মতের আলিমগণ সর্বসম্মতিক্রমে যদি তাকে কাফির বলে
ফাতওয়া দেন এবং তার নামায, রোযা, তার কল্পিত ইসলাম প্রচারের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করেন, তাহলে নিঃসন্দেহে তারা সাহাবায়ে কিরামের আদর্শের অনুসরণ করেন। এ কারণে তাদেরকে কান প্রকার তিরস্কার করা যাবে না ।
বনী কাহতানের প্রতিনিধি দল: তাদের আমীর ছিলেন যায়দুল খাইল । তারা সবাই উপস্থিত হয়ে মুসলমান হয়ে যায়।
বনী হারেসের প্রতিনিধি দল: তাদের মাঝে হযরত খালিদ বিন ওলীদ রা. ছিলেন। তিনি তার সকল সাথী সঙ্গীসহ মুসলমান হয়ে যান। এমনিভাবে বনী আসাদ, বনী মুহারিব, হামাদান, গাস্সান ইত্যাদি প্রতিনিধি দল কেউ উপস্থিত হবার পূর্বে আর কেউ পরে মুসলমান হয়ে যায়। হিময়্যারের বিভিন্ন সরদার যাদেরকে নিজ নিজ দলের বাদশা মনে করা হত, তাদের পক্ষ থেকে দূতগণ এ খবর নিয়ে আসল যে, তারা সকলেই সন্তুষ্টি ও আগ্রহের সাথে ইসলাম কবুল করেছেন। এভাবে পদাতিক এবং আরোহীগণের প্রতিনিধি দল উপস্থিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করতে থাকল। এমনকি দশম হিজরীতে মহানবী সা. এর সাথে হজ্বে এক লাখ থেকে বেশী মুসলমান ছিলেন। যারা তখন উপস্থিত ছিলেন না, তাদের সংখ্যা এর থেকে কয়েকগুণ বেশী ছিল।
সিদ্দিকে আকবর আমীরে হজ্ব হওয়া: তবুক যুদ্ধের পর ৯ই যি-কা‘দাতে মহানবী সা. সিদ্দিকে আকবর রা.কে আমীরে হজ্ব বানিয়ে মক্কায় পাঠান।