Narrow selection

​​​​​​​ব্রেন স্ট্রোক কিভাবে হয়? - How does a brain stroke happen?


06:06:12 12/11/2023

ব্রেন স্ট্রোক কিভাবে হয় - স্ট্রোক এড়াবেন কীভাবে

 

 

ছামাদ সাহেবের বয়স ৫৫, সচিবালয়ের কর্মকর্তা। একদিন অফিসে বসে গুরুত্বপূর্ণ ফাইলপত্র দেখছেন, মাঝে মাঝে নোট লিখছেন। সারাদিন কর্মব্যস্ততায় কিছুটা ক্লান্তিবোধ করছেন। জ্বলন্ত সিগারেটটা ঠোঁটে লাগিয়ে আবার কিছু একটা লিখতে শুরু করলেন কিন্তু আর লিখতে পারছেন না। মুখ থেকে সিগারেটটা খসে পড়লো। পাশের টেবিলে বসা শফিক সাহেবকে তিনি সমস্যার কথা বলতে চাইলেন কিন্তু মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না। কার্পেট পোড়া গন্ধে চমক ভাঙলো শফিক সাহেবের। তাকালেন ছামাদ সাহেবের দিকে। অসুস্থ মনে হচ্ছে না ওকে! দ্রুত হাসপাতালে নেয়া হলো ছামাদ সাহেবকে।

চিকিৎসক পর্যবেক্ষণ করে মন্তব্য করলেন, 'স্ট্রোক হয়েছে'। বেশ কিছুদিন ধরে হাসপাতালের চিকিৎসা শেষে ছামাদ সাহেব কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলেও তার ডান হাত, ডান পাসহ শরীরের ডান পাশের অংশ অবশ হয়ে গেল। এমনিভাবে 'স্ট্রোক'-এ আক্রান্ত একজন কর্মচঞ্চল মানুষ মুহূর্তে কর্মহীন হয়ে পড়েন এবং মারা যান। পশ্চিমা বিশ্বে প্রতি বছর এক হাজার লোকের মধ্যে দুজন স্ট্রোকের শিকার হন — বাংলাদেশে তো আরো বেশি।

স্ট্রোক আসলে কী

কোনো কারণে মস্তিষ্কে রক্ত চলাচলে বিঘ্নতার দরুন যে ক্ষতি হয় সেটাকে স্ট্রোক বলে। এক্ষেত্রে মস্তিষ্কের টিস্যু ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

রক্তচলাচলের বিঘ্নতা দুভাবে ঘটে থাকে।

১. রক্ত জমাট বাধা মস্তিষ্কের রক্তনালিতে রক্তজমাট বেধে গিয়ে কিংবা শরীরের যে কোনো অংশের জমাট বাধা রক্ত মস্তিষ্কে পৌঁছে রক্তনালিতে আটকে গিয়ে রক্ত চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। চিকিৎসা পরিভাষায় এটাকে থ্রম্বোসিস বলে ।

২. মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ : অর্ধেক স্ট্রোকই সংঘটিত হয় মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণের কারণে। কোনো কারণে মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহকারী রক্তনালি ছিঁড়ে গেলে রক্ত আটকে গিয়ে রক্ত চলাচলে সীমাহীন বিঘ্নতার সৃষ্টি হয়।

মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল বিঘ্নিত হলে অক্সিজেন এবং শর্করা সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় এবং এর ফলে মস্তিষ্কের এই অংশের মৃত্যু ঘটে। রোগী কিছু অনুভব করার আগেই এ দুর্ঘটনা ঘটে যায়। কখনো কখনো বন্ধ হয়ে যাওয়া রক্তনালি পুনরায় সচল হয়ে যায় এবং এর ফলে মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা পুনরায় ফিরে আসে।

৫০ বছরের কম বয়সী লোকদের স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম। একজন পুরুষ একজন নারীর চেয়ে দেড়গুণ বেশি স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। কখনো কখনো মস্তিষ্কের রক্তনালীতে আঘাত, প্রদাহ কিংবা রক্তনালীর জন্মগত ত্রুটি থেকে কমবয়সীরা স্ট্রোকের শিকার হতে পারেন।

স্ট্রোকের ঝুঁকিপূর্ণ কারণ

  • উচ্চ রক্তচাপ
  • ধূমপান
  • ডায়াবেটিস মেলাইটাস
  • রক্তে চর্বির অধিক উপস্থিতি
  • পলিসাইমেথিয়া ও থ্রম্বোসাইমেথিয়া রোগ
  • (অস্বাভাবিকহারে রক্তে লোহিত কণিকা ও অণুচক্রিকা বেড়ে যাওয়া)
  • অত্যধিক মদ্যপান
  • পারিবারিক স্ট্রোকের ইতিহাস।
  • জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি সেবন
  • মস্তিষ্কে আঘাত ।

স্ট্রোকের প্রকারভেদ

১. পূর্ণাঙ্গ স্ট্রোক মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ কিংবা রক্তক্ষরণের কারণে মস্তিষ্কের কার্যকারিতা

লোপ পায়। ২০ ঘণ্টার বেশি সময় উপসর্গ স্থায়ী হতে পারে না। অল্প কয়েক মিনিটের মধ্যে স্ট্রোকের উপসর্গ দেখা দেয় এবং এক বা দু'ঘন্টার মধ্যে অবস্থা চরম পর্যায়ে পৌঁছায়। কখনো কখনো ধীরে ধীরে অবস্থার অবনতি হয়। মাথাব্যথা হয়। এক্ষেত্রে রোগীকে পরীক্ষা করে মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়েছে নাকি রক্তক্ষরণ হয়েছে তা পার্থক্য করা যায় না; তবে খিঁচুনি, বমি এবং অজ্ঞান হয়ে গেলে বুঝতে হবে তীব্র ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে।

২: উদ্ভাবিত স্ট্রোক : এক্ষেত্রে স্ট্রোকের লক্ষণসমূহ ধীরে ধীরে কয়েক ঘণ্টা বা কয়েক দিনে বিস্তার লাভ করে। মস্তিষ্কের টিউমার কিংবা রক্ত জমে গেলে এই উপসর্গ প্রকাশ পায়, তবে এ ধরনের স্ট্রোক সচরাচর বেশি ঘটে মস্তিষ্কের কোনো প্রধান নালি; যেমন- ইন্টারনাল ক্যারোটিড কিংবা মিডল সেরিব্রাল ধমনী ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাবার কারণে।

৩. সাময়িক রক্তহীনতাজনিত আঘাত: মস্তিষ্কের রক্ত সরবরাহ কমে গেলে এ ধরনের স্ট্রোক দেখা দেয়। উপসর্গ ২৪ ঘণ্টার কম স্থায়ী হয়। অনেক ক্ষেত্রে মাত্র কয়েক মিনিট। এক্ষেত্রে রোগীর মাথা ঘোরে, কোনো জিনিস দুটো করে দেখে, হাত পা অবশ হয়ে যায় এবং চেতনা লোপ পায় ।

সাধারণভাবে স্ট্রোকের উপসর্গ

ক. ক্যারোটিড এবং মস্তিষ্কের ধমনী আক্রান্ত হলে-

  • হাত, বাহু কিংবা মুখমণ্ডল দুর্বল হয়ে আসে
  • কথা বলতে অসুবিধা হয়, বাকশক্তি লোপ পায়
  • মুখের একপাশ, বাহুর একপাশ, পায়ের একপাশ অসাড় হয়ে আসে
  • একই পার্শ্বের চোখে দৃষ্টিহীনতা দেখা দেয়।

খ. ভার্টিব্র ব্যাসিলার ধমনী আক্রান্ত হলে-

  • হতবিহ্বল, মাথাঘোরা, বাকশক্তি লোপ, কোনো জিনিস দুটো করে দেখা এবং জড়িয়ে জড়িয়ে কথা বলা প্রভৃতি উপসর্গ প্রকাশ পায়।
  • রোগী অজ্ঞান না হয়ে পড়ে যেতে পারে।
  • দৃষ্টিশক্তি লোপ পায়।

চিকিৎসা

স্ট্রোকের রোগীকে প্রাথমিক অবস্থায় হাসপাতালে রাখতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মতো ব্যবস্থা নিতে হবে।

সাধারণ ব্যবস্থা

১. সতর্কতামূলক সেবা প্রদান : রোগীর যাতে শরীরের ত্বকে ঘা না হয় সেজন্য কিছুক্ষণ পর পর রোগীকে একবার ডানপাশ, একবার বাঁপাশ করে শুইয়ে দিতে হবে। ত্বক সর্বদা শুকনো এবং পরিষ্কার রাখতে হবে।

২. শ্বাস পথের যত্ন : রোগী অজ্ঞান থাকলে ওরোফেরিনজিয়াল টিউব দিয়ে তার শ্বাসনালীর নিঃসরণ পরিষ্কার করে দিতে হবে।

৩. পানির সমতা রক্ষা : রোগী যদি ঢোক গিলতে না পারে তাহলে নাকে নল দিয়ে খাওয়াতে হবে। রোগীর যাতে পানিশূন্যতা দেখা না দেয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। মূত্রথলি ভরে গেলে নল দিয়ে তাকে প্রস্রাব করাতে হবে।

৪. ফিজিও থেরাপি : অস্থিসন্ধির সংকোচন রোধে, বুকের নিঃসরণ পরিষ্কার করতে এবং দেহে শক্তি ও সমন্বিত অবস্থা ফিরিয়ে আনতে দ্রুত ফিজিও থেরাপি শুরু করতে হবে। ৫. স্পিচ থেরাপি : প্রাথমিক অবস্থা কেটে গেলে রোগীকে স্বাভাবিক কথা বলানোর জন্য প্রয়োজনে স্পিচ থেরাপি দিতে হবে।

বিশেষ অবস্থা

এক্ষেত্রে চিকিৎসকই সবকিছু করে থাকেন। বিভিন্ন ওষুধ ব্যবহারের ব্যাপারে তিনি নির্দেশনা দেন। স্ট্রোকের রোগীর মস্তিষ্কের অবস্থার কারণে হঠাৎ রক্তচাপ বাড়তে পারে। সুতরাং -রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের ওষুধ ব্যবহারে খুবই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যদি রক্তনালীতে কোনো প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয় তাহলে চিকিৎসক রক্তের জমাট বিচূর্ণকারী ওষুধ দিতে পারেন। তবে অবশ্যই সিটি স্ক্যান করে নিশ্চিত হতে হবে সেটা মস্তিষ্কে রক্তপাত নাকি টিউমার। পানির স্ফীতি কমানোর জন্য চিকিৎসক অসমোটিক এজেন্ট যেমন ম্যানিটল ইনজেকশন দিতে পারেন। তীব্র স্ট্রোক স্টেরয়েড দিয়ে থাকেন। কখনো কখনো শল্য চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে। তবে সেটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।

পরবর্তী অবস্থা

প্রায় ৩০ ভাগ স্ট্রোকের রোগী প্রথম আঘাতেই মৃত্যুবরণ করে থাকেন। অবিশিষ্টাংশদের অধিকাংশই ১-১২ মাসের মধ্যে প্রয়োজনীয় শারীরবৃত্তির কাজ করার ক্ষমতা অর্জন করতে থাকেন। এক্ষেত্রে ফিজিওথেরাপিস্ট, স্পিচ থেরাপিস্ট এবং অক্যুপেশনাল থেরাপিস্টদের প্রত্যক্ষ সাহায্য একান্ত প্রয়োজন। সাময়িক রক্তহীনতাজনিত আঘাত (ট্রানজিয়েন্ট ইসকেমিক অ্যাটাক)-এর ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়গুলো চিহ্নিত করে তা সংশোধন করতে হবে। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ধূমপান সম্পূর্ণ পরিহার করতে হবে। দৈনিক ৩০০ মিলিগ্রাম এসপিরিন খেয়ে গেলে শতকরা ২৫ ভাগ স্ট্রোকের সম্ভাবনা কমে যায়। যদি রোগী ৩০০ মিলিগ্রাম এসপিরিন সহ্য করতে না পারেন তাহলে মাত্রা কমিয়ে ৭৫-১৫০ মিলিগ্রাম সেবন করা যেতে পারে। টিলকোপিডিন নামক ওষুধটি এক্ষেত্রে ভালো কাজ করে।

 

 


No comments yet


Leave a comment

 


Name *:



Design theme color

Primary color


Alternative color