Narrow selection

How to write stories?


05:15:42 12/04/2023

কিভাবে গল্প লিখতে হয়?

ভাই আবদুল জলীল: পিছনের আলোচনাগুলোতে এ পর্যন্ত আমরা লেখার ভাষাগত ও শব্দগত দিক সংশোধন সম্পর্কে আলোচনা করেছি। তোমার লেখাটি পেয়ে মনে হলো, লেখার শরীর ও দেহকাঠামো সম্পর্কে কিছু আলোচনা করা দরকার। একটি লেখাকে তুমি একটি মানবদেহের সঙ্গে তুলনা করতে পারো। মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেহের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ রয়েছে। দেহের যে অঙ্গ যেমন হওয়া দরকার তেমন না হলে অসুন্দর হয়। তদ্রূপ যদি কোন অঙ্গচ্ছেদ ঘটে, একটি হাত, একটি পা না থাকে তাহলে সেটাকে দেহের গুরুতর খুঁত বলে গণ্য করা হয়। আবার দেহ যদি সুঠাম না হয়, বরং মেদবহুল হয় তাহলে সেটাও দোষের হয়।

লেখায়ও বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের মাঝে ভারসাম্য থাকতে হবে। যেটা ছোট হওয়া দরকার সেটা বড় হলে, যেটা বড় হওয়া দরকার সেটা ছোট হলে, বা কোন অঙ্গহানি ঘটলে সে লেখাটা গুরুতরভাবে অসুন্দর হয়ে যাবে। লেখাতে যদি কোন অপ্রয়োজনীয় অংশ এসে যায় তাহলে সেটা হবে দেহের অপ্রয়োজনীয় মেদের মত, অপ্রয়োজনীয় মেদ অবশ্যই দেহ থেকে ঝেড়ে ফেলতে হয়। দেহ সুঠাম সুন্দর হলে তবেই না আসে অলংকারসজ্জা এবং পোষাক পরিচর্যার প্রশ্ন। কংকালসার বা মেদসর্বস্ব দেহে যত অলংকারই চড়াও এবং যত সুন্দর পোষাকই পরাও তা কারো মুগ্ধ দৃষ্টি আকর্ষণ করবে না। যদি হাত না থাকে তাহলে চুড়ি এবং যদি পা না থাকে তাহলে ঝুমুর পরার তো প্রশ্নই আসে না।

তদ্রূপ একটি লেখার শরীর ও দেহকাঠামো যখন সুঠাম ও সুন্দর হবে, সব অঙ্গ যখন ঠিক থাকবে তখন সুন্দর অলংকারসজ্জার ও পোশাক পরিচর্যার, অর্থাৎ সুন্দর ভাষা ব্যবহার করার প্রশ্ন আসবে। এ ছাড়া সুন্দর ভাষারও কোন মূল্য থাকে। না তো ভাই আবদুল জলীল, তোমার লেখাটির শরীর ও দেহকাঠামো সম্পর্কে কিঞ্চিৎ আলোচনা করা হলো। তোমার লেখার শিরোনাম হলো- 'আমার চোখে তার মৃত লাশটি এখনো ভাসে' তোমার লেখার ভঙ্গি ও শব্দচয়ন মোটামুটি ভালো। নিয়মিত অনুশীলন করলে উন্নতি হবে, আশা করি।

কয়েকটি বিষয় দেখবো।

(ক) বানানের প্রতি তোমার যত্ন কম। লেখা শেষ করার পর কর্তব্য হলো অভিধান দেখে প্রয়োজনীয় শব্দগুলোর বানান সংশোধন করা। বানানের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে সুনিশ্চিত না হয়ে কোন লেখা ছেড়ে দেবে না। 'হুজুরদের শান, অশুদ্ধ বানান'- এই বদনাম থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করো।

(খ) লেখার শিরোনাম সংক্ষিপ্ত ও আকর্ষণীয় হওয়া উচিত। যেমন- 'এখনো চোখে ভাসে সেই লাশ।' তুমি 'মৃতলাশ' লিখেছো। লাশ তো মৃতই হবে, তাই অনর্থক । অবশ্য 'মৃতদেহ' হতে পারে। মৃতলাশ

(গ) বিষয়বস্তু বা ঘটনা শুরু থেকে শেষ এমনভাবে সাজাতে হবে যেন কোন অসঙ্গতি বা অস্বাভাবিকতা না থাকে। একটি সুস্থ সুঠাম দেহের মত একটি সুন্দর সুঠাম লেখাই হলো পাঠকের কাম্য।

তোমার লেখা ঘটনাটা মোটামুটি এ রকম-

*আব্দুস সালাম ছেলেটা ফজরের পর ঘরে বসে সূরা ইয়াসিন তেলাওয়াত করছে ..... তার ছোট বোন রাস্তার এক হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে তাকে খবর দিলো। সে গিয়ে দেখলো যে, নিহত মহিলা তাদের প্রতিবেশী ষাট বছরের বৃদ্ধা ছেলে ইউনুস শিকারপুর থেকে ফেরার সময় পথেই মায়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলো রাতে ছেলে ফিরে আসছে না দেখে বৃদ্ধা 'শতবার' প্রার্থনা করছিলো। এশার পরও যখন ছেলে এলো না তখন বৃদ্ধা কুপি হাতে বের হলো পাশ্ববর্তী বাড়ির ফজলু মিয়ার কাছে ছেলের সংবাদ নিতে। কেননা ছেলে তার সাথে একত্রে ভ্যান চালায়।

সে জানালো যে, ইউনুস ভ্যানের খেপ নিয়ে শিকারপুর গেছে, রাতে ফিরবে না। বৃদ্ধা বাড়িতে ফেরার পথে এক ঝোপের আড়ালে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে।' তোমার ঘটনার শরীর কাঠামোতে বড় বড় কয়েকটি ত্রুটি রয়েছে। অবশ্য হতাশ হওয়ার কিছু নেই। শুরুতে এ রকম হওয়াই স্বাভাবিক। ছোটকালে আমি একবার একটা গল্প লিখেছিলাম, আমি নিজেই ছিলাম গল্পের নায়ক। গভীর বনের ভিতর দিয়ে যাচ্ছি। ক্ষুধা ও পিপাসায় কাতর অবস্থা। এমন সময় দেখি, রাস্তায় অর্ধেক পানি ভরা একটা বালতি। তাতে একটি আপেল ভাসছে। সেই আপেল খেয়ে এবং পানি পান করে ক্ষুধা ও পিপাসা দূর করলাম।

পাঠকের মনে প্রশ্ন হতে পারে, গভীর বনে এমন 'সাজানো দরস্তখান' এলো কোত্থেকে? কিন্তু সে কথা ভেবে দেখার অবসর ছিলো না আমার। পেটে ক্ষুধা, গলায় পিপাসা, আর হাতে কলম, সুতরাং আর কেন দেরী? বালতি ভরা পানি ও আপেলের ব্যবস্থা করে ফেললাম! পাঠকের মনে কী প্রশ্ন আসবে, সেটা ভাবার যোগ্যতা তখন আমার কোথায়? অথচ দেখো, বনের যে কোন একটা গাছে,

চকবাজারের আপেলের পরিবর্তে একটা বন্য ফল ঝুলিয়ে দিতে পারতাম, আর তারই পাশ দিয়ে স্বচ্ছ পানির ঝরণা বইয়ে দেয়া যেতো। তাতে আমার ক্ষুধা, পিপাসাও দূর হতো। পাঠকেরও গল্পটা হজম হতো। কিন্তু অত সব চিন্তার বালাই কি আর তখন ছিলো।

যাই হোক, বলছিলাম যে, শুরুর দিকে এরকম কাঁচা কাজ হতেই পারে।

কিন্তু আমাদের সময় ত্রুটি ধরিয়ে দেয়ার কেউ ছিলো না। থাকলে আরো অনেক আগে আমাদের লেখা আরো অনেক উপরে উঠতো। অবশ্য এখন আর সে আফসোস করে লাভ নেই। আমাদের সময় তো প্রায় শেষ হয়ে এলো, তোমরা এখন থেকে মনোযোগী ও যত্নবান হও।

ভাই আরেফীন, এবার তোমার লেখার শারীরিক ত্রুটিগুলো দেখো-

(ক) আব্দুস সালামের প্রতিবেশিনী বৃদ্ধা মাত্র এশার সময় ছেলের খোঁজ নিতে পার্শ্ববর্তী ফজলু মিয়ার বাড়ি গেলেন, ফেরার পথে খুনীদের দেখে দৌড় দিলেন আর খুনীরা তাকে ধরে জবাই করলো, অথচ পাড়া পড়শী কেউ টের পেলো না। পাঠকের কাছে এটা কি বিশ্বাস্য হবে?

(খ) তাছাড়া ষাট বছরের 'বুড়ীকে' এভাবে খুন করার কারণ সম্পর্কে কিছুই বলোনি তুমি, পাঠক কি তা মেনে নেবে?

(গ) যে ছেলে ভ্যানগাড়ী চালিয়ে সংসার চালায় তার জন্য সন্ধ্যা না হতেই অস্থির হয়ে ‘শতবার' আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা' কি খুব স্বাভাবিক?

(ঘ) ফজরের পর পর আব্দুস সালাম ছোট বোনের কাছে খুনের ঘটনা জানবে কেন? সে কি নামাজের জন্য মসজিদে যায়নি? যাওয়ার কিংবা ফেরার পথে সে নিজেই তো তা জানতে পারতো

দেখো, কাহিনীটা তুমি এভাবে সাজাতে পারতে-

(ক) আব্দুস সালাম ফজর বাদ হাঁটতে বের হয়, সূরা ইয়াসীন পড়তে পড়তে... (খ) দু'চার জন মানুষের জটলা দেখে সেখানে যাবে এবং বৃদ্ধার লাশ দেখবে, সেখানে ফজলু মিয়ার কাছে ঘটনা শোনবে। (ফজলু মিয়ার বাড়ী হবে বৃদ্ধার বাড়ী থেকে দূরে এবং হত্যাকাণ্ডটি হবে নির্জন স্থানে। )

(গ) একটু পর বৃদ্ধার পুত্র ভ্যানগাড়ী নিয়ে সেই পথ দিয়ে আসতে থাকবে এবং মায়ের লাশ দেখে স্তব্ধ হয়ে যাবে। তারপর চিৎকার করে মায়ের মৃতদেহের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। (পুরুষ মানুষের অজ্ঞান হওয়ার দরকার নেই)

(ঘ) একটা কানাকানি চলবে যে, এটা এলাকার প্রতাপশালী চেয়ারম্যানের কাজ। কেননা অনেক দিন থেকে বৃদ্ধার ভিটেটার প্রতি তার লোভ ছিলো। হয়ত সেখানে তার বাগানবাড়ী করার ইচ্ছা। কিন্তু চেয়ারম্যানের ভয়ে কেউ কথাটা বলতে সাহস পাবে না।

(ঙ) ঘটনা বর্ণনার ফাঁকে ফাঁকে তোমার বিভিন্ন চিন্তা-ভাবনা তুলে ধরতে পারো। যেমন- পুত্রের খোঁজে বের হওয়া প্রসঙ্গে মাতৃ-মমতা সম্পর্কে কিছু কথা- ভ্যানগাড়ী চালিয়ে মায়ের সেবাকারী বালক সম্পর্কে কিছু কথা-

চেয়ারম্যানের প্রসঙ্গে, সমাজে ধনী-গরীব ও আইনের বৈষম্য ইত্যাদি সম্পর্কে কিছু কথা। এতে তোমার লেখাটা ছোট একটা খুনের ঘটনাকেন্দ্রিক হয়েও নতুন নতুন মাত্রা লাভ করে বহুমাত্রিক হবে।

এবার তুমি উপরের পরামর্শের আলোকে ঘটনাটা নতুনভাবে লেখো। আশা করি যত্ন করে লিখলে তোমার লেখা আরো সুন্দর ও নিখুঁত হবে ইনশাআল্লাহ। এবার তোমার লেখার কিছু শব্দ ও বাক্য সম্পর্কে আলোচনা করছি-

তুমি লিখেছো- ‘গগন বিদারী আর্তচিৎকারে পরিবেশ থমথমে হয়ে গেলো'। থমথমে অর্থ ভীতিজনক নিস্তব্ধতা! তাছাড়া আর্তচিৎকার হয় করুন, সেটা গগনবিদারী হয় না।

তুমি লিখেছো-

'এ দৃশ্য দেখে আব্দুস সালামের চোখে যেন শ্রাবণের বর্ষণ শুরু হলো।'

এখানে প্রবল অশ্রুপাতকে শ্রাবণের বর্ষণের সাথে উপমা দেয়া হয়েছে। উপমাটা তোমার পছন্দ হয়েছে নিশ্চয়! কিন্তু এটা হৃদয় ও প্রণয়ের ক্ষেত্রে মানাবে, খুনের ঘটনায় মানায় না। এখানে শুধু চোখের পানি যথেষ্ট। তাছাড়া শ্রাবণের বর্ষণ চোখে হয় না, চোখ থেকে হয়।

তুমি লিখেছো-

'দুটি ছেলে নিয়ে বিধবার পরিবার।' বিধবা বৃদ্ধার পরিবার না লিখে সংসার লেখা ভালো ছিলো।

সুযোগ থাকলে তোমার লেখাটায় শরীর কাঠামো ও ভাষাগত বিষয়ে আরো কিছু আলোচনা করা যেতো। তবে আশা করি, এতেই তুমি এবং অনান্য সাথীরা চিন্তার যথেষ্ট খোরাক পাবে।

 

 


No comments yet


Leave a comment

 


Name *:



Design theme color

Primary color


Alternative color