মাতৃভাষা চর্চায় ইসলামের গুরুত্ব - Importance of Islam in mother tongue practice
04:42:22 12/04/2023
মাতৃভাষা চর্চায় ইসলামের গুরুত্ব ২১শে ফেব্রুয়ারী বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস
ভাষা মহান নেয়ামত: আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে যত নেয়ামত দান করেছেন তন্মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি নেয়ামত হল ভাষা, কথা বলার শক্তি। মনের সূক্ষ্মতিসুক্ষ্ণ আকুতিকে প্রকাশ করার জন্য আমরা মুখের মাধ্যমে যে শব্দ বের করি সেটা হল ভাষা । ভাষা আল্লাহর দেয়া সবচেয়ে বড় এক নেয়ামত। আল্লাহ বলেন, তুমি যদি আমার কুদরত ও নিদর্শন দেখতে চাও আমার অনেক কুদরত তুমি দেখতে পাবে, তন্মধ্যে কয়েকটি হল-
و من اياته اختلاف الوانكم والسنتكم
(তার এক নিদর্শন হল তোমাদের রং, ধরণ এবং ভাষার বিভিন্নতা)
পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের দিকে যদি তুমি তাকাও তাহলে দেখতে পাবে প্রতিটি মানুষ একেকটি পৃথক মডেল। দুটি মানুষ একই পরিবারে, একই গোত্রে বা একই দেশে হুবহু এক রকম হয়না। এখানে যদি তুমি চিন্তা কর তাহলে বুঝতে পারো যে, আল্লাহর শৈল্পিক নিপুণতা কত বিচিত্র। বর্তমান পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ আছে। সারা পৃথিবীর কোন অঞ্চলের দু'জন মানুষ এক রকম পাওয়া যাবেনা । এত কোটি কোটি মডেল যার কাছে আছে সে আল্লাহ তো কত মহান স্রষ্টা ও শিল্পী । তার কুদরত কত বিশাল । পৃথিবীর একেক দেশের একেক অঞ্চলের মানুষ একেক ভাষায় কথা বলে । এটাও আমার নিদর্শন যে, ভাষাকে আমি বিভিন্ন করেছি । আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আরো বলেন-
خلق الانسان وعلمه البيان
করার জ্ঞান
মানবজাতিকে তিনি সৃষ্টি করেছেন বর্ণনা দিয়েছেন । মানবজাতি অস্তিত্বহীন ছিল, তাদেরকে অস্তিত্ববান করেছেন । অনেক সৃষ্টির মধ্যে মানুষকে বিশেষ করে আল্লাহ যে নেয়ামত দান করেছেন, তা হল l বা ভাষা। আল্লাহ তাদের মনের আকুতি প্রকাশের জন্য দান করেছেন কথা বলার শক্তি বা বাক শক্তি। এটা আল্লাহ পাকের অপূর্ব নেয়ামত। আল্লাহ পাক প্রত্যেক জাতিকে, প্রত্যেক অঞ্চলের মানুষকে পৃথক ভাষা দান করেছেন । সবগুলো আল্লাহরই দেয়া ভাষা। কাজেই এটা আল্লাহর ভাষা; ওটা আল্লাহর ভাষা নয়, এমন বলা যাবে না।
আদমের (আঃ) ভাষা জ্ঞান :
আল্লাহ পাক যখন হযরত আদম (আঃ) কে তৈরী করেছেন তাকে সব ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন । আল্লাহ বলেন-
وعلم آدم الأسماء كلها
(হযরত আদমকে সৃষ্টি করার পর যত ভাষা দুনিয়াতে আছে সবকিছুর জ্ঞান তাকে তিনি দান করেছেন) । এই আয়াতের আলোকে বুঝা যায় পৃথিবীর সব ভাষা আল্লাহ কর্তৃক সৃষ্ট । সূরা রূমের আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, তোমরা যে বিভিন্ন ভাষায় কথা বল, এটা আল্লাহর কুদরত। সূরা বাকারার আয়াত দ্বারা বুঝা যায়, আল্লাহ পাক হযরত আদমকে সব ভাষা শিক্ষা দান করেছেন।
সারা পৃথিবীর মুসলমান যে যে জনপদে বাস করে সে ঐ অঞ্চলের ভাষায় কথা বলতে পারে। তবে মুসলমান হিসেবে প্রত্যেকের প্রিয় ভাষা হল আরবী । কারণ, আল্লাহ পাক তার মহান গ্রন্থ নাযিল করার জন্য অনেক ভাষা থেকে আরবী ভাষাকে চয়েজ করেছেন। আল্লাহ বলেন- অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ আমি নাযিল করেছি অনারব আজমী ভাষায়, কুরআনকে নাযিল করার জন্য আমি নির্বাচন করেছি স্পষ্ট ভাষা, আরবী ভাষা। তিনি বলেন-
لسان الذي يلحدون اليه اعجمى وهذا لسان عربي مبين
আরবী যখন আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত ভাষা, তাই প্রতিটি মুমিনকে আরবী ভাষা ভালবাসতে হবে । তবে আরবী ভাষাকে ভালবাসার অর্থ এ নয়, নিজের ভাষাকে চর্চা করা যাবে না । আমরা দেখতে পাই, সাহাবায়ে কেরাম আল্লাহর নবীর যুগেই অনেক দূরে গিয়ে দ্বীনের দাওয়াত প্রচার করেছেন। যে জাতির কাছে তারা গিয়েছেন সে জাতিকে বুঝানোর জন্য তাদের ভাষায় দাওয়াত দিয়েছেন। বিভিন্ন জাতির নিকট যে ভাষাগুলো ছিল সেগুলোকে আল্লাহ নিষিদ্ধ করে দেননি । সূরায়ে ইব্রাহীমে আল্লাহ পাক বলেন-
وما ارسلنا من رسول الا بلسان قومه ليبين لهم
আমি দুনিয়ার বুকে অনেক নবী-রাসূল প্রেরণ করেছি, কিন্তু এমন কোন নবী রাসূল প্রেরণ করিনি, যারা তাদের জাতীয় ভাষা জানত না। যেই জাতির কাছে যে নবী- রাসূলকে প্রেরণ করেছি সে জাতির ভাষায় অভিজ্ঞ করে তাদেরকে আমি প্রেরণ করেছি।" কাজেই নিজের জাতীয় ভাষাকে আয়ত্ত্ব করা, সে ভাষায় বিশুদ্ধতা অর্জন করা কুরআন এবং সুন্নাহর আলোকে কর্তব্য মহানবী (সাঃ) ভাষা দক্ষতা : আল্লাহর রাসূল বলেন-
انا افصح العرب
আমাকে আল্লাহ আরব দেশে প্রেরণ করেছেন, আরবী ভাষায় আমাকে পান্ডিত্য দান করেছেন এবং আমি বিশুদ্ধ আরবী ভাষা জানি। প্রাতিষ্ঠানিক কোন জ্ঞান না থাকার পরেও আল্লাহর রাসূলের মুখ নিসৃত শব্দগুলো ছিল ভাষা শৈলীর দৃষ্টিকোণ থেকে, ভাষা সাহিত্যের মানদন্ডে অত্যন্ত উঁচু মাপের । আজো আল্লাহর রাসূলের মুখ দিয়ে নিসৃত হাদীসগুলো সাহিত্যের সমৃদ্ধ ভান্ডার হিসেবে পরিচিত এবং এ হিসেবে হাদীসের গবেষণা করা হয়। নিঃসন্দেহে কোরআনের পর আরবী সাহিত্যের সবচেয়ে বড় ভান্ডার হল আল্লাহর রাসূলের হাদীস। অত্যন্ত বিশুদ্ধ ভাষায় আমাদের নবীজী কথা বলতেন। নবীগণ অত্যন্ত সুন্দর মাধুর্যপূর্ণ ভাষায় মানুষকে দাওয়াত দেন। এজন্যই তাদের বাণীর প্রভাব মানুষের অন্তরের গভীরে বিম্বিত হয় । আল্লাহ বলেছেন-
ليبتن لهم
আমি নবী এবং রাসূলকে তাদের ভাষায় অভিজ্ঞ কেন করেছি? যাতে সুন্দর এবং সহজ করে আমার বাণী মানবজাতির কাছে তুলে ধরতে পারে। তাছাড়া সুন্দর ও বিশুদ্ধ ভাষায় কথা বলা উঁচু ব্যক্তিত্বের পরিচায়ক । নবী-রাসূলগণ ছিলেন বড় ব্যক্তিত্বের অধিকারী ।
গর্বিত একুশ
ফেব্রুয়ারী মাস বাংলাদেশের বাংলাভাষী মানুষের জন্য ভাষার মাস। নিজের মায়ের ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা দেয়ার জন্য ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারী তারা রাজপথে নেমেছিল এবং গুলির আঘাতে আহত হয়েছিল, শহীদ হয়েছিল, রক্তাক্ত হয়েছিল। এই অঞ্চলের মানুষ রক্ত দিয়ে তাদের মায়ের ভাষাকে হিফাজত করেছে। প্রথমে স্পষ্ট জেনে নিতে হবে যে, যে অঞ্চলে মুসলমান প্রেরিত হবে সে অঞ্চলের ভাষাই হবে তার ভাষা । সে ভাষায় তাকে অভিজ্ঞ হতে হবে । এটা নবী এবং রাসূলদের সুন্নাত।
কারণ, নবী-রাসূলরা তার জাতির ভাষায় অভিজ্ঞ ছিলেন। এমন বলা যাবেনা যে, বাংলা ভাষায় হিন্দুরা কথা বলে, তাদের দেব-দবীর নাম আছে, এই জন্য এই ভাষা মুসলমানদের নয় । আরবী ভাষা কোরআন নাযিল হওয়ার আগেতো আবু জেহেল, আবু লাহাবের ভাষা ছিল, কিন্তু কোরআন নাযিল হওয়ার পরে এটা মুসলমানদের ভাষা হয়েছে । দ্বিতীয়ত: ফার্সি ভাষা অগ্নি পূজারীদের ভাষা ছিল, যারা অগ্নি পূজা করত, তারা ফার্সি ভাষায় কথা বলত।
ইরান ও পারস্য দেশগুলোতে মুসলমানরা যখন ইসলামের দাওয়াত প্রচার করল সেখানের মানুষ ইসলাম গ্রহণ করল। তখন তারা ফার্সি ভাষাতেই ইসলামের চর্চা শুরু করল। এক পর্যায়ে ফার্সি ভাষা ইসলামী সাহিত্যে দ্বিতীয় নম্বর সমৃদ্ধ ভাষা হয়ে যায়। আল্লামা সা'দী (রহঃ) ফার্সি ফাযায় বোসতাঁ লিখেছেন, গুলিস্তাঁ লিখেছেন, কারিমা লিখেছেন। ফরিদ উদ্দীন আত্তার (বড় বুযুর্গ), তিনি পান্দেনামা লিখেছেন ফার্সি ভাষায় । ইমাম রূমী (রহঃ) 'মসনবী' লিখেছেন ফার্সি ভাষায় ।
আল্লামা জামী (রহঃ) ফার্সিতে কবিতা লেখেছেন, বড় বড় আলেম, দার্শনিক, কবি-চিন্তাবিদ অগ্নিপূজারিদের ভাষাকে ইসলামী সাহিত্যে সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁরা ইসলাম চর্চা করার কারণে ফার্সি ভাষা আরবীর পরে দ্বিতীয় ইসলামী ভাষায় পরিণত হয়েছে। এর পরে উর্দূ ভাষায় অধিক হারে ইসলাম চর্চা করার কারণে তা ইসলামী সমৃদ্ধ ভাষায় পরিণত হয়েছে । অনেক আলেম, মুসলিম চিন্তাবিদ, সাহিত্যিক উর্দুভাষায় সাহিত্য রচনা করার কারণে ইসলামী সাহিত্যের এক বিশাল ভান্ডার উর্দূ ভাষায় সৃষ্টি হয়েছে। দার্শনিক কবি আল্লামা ইকবাল উর্দূতে ইসলামী সাহিত্যের জোয়ার সৃষ্টি করেছিলেন ।
একই ভাবে যদি মুসলমানরা বাংলাভাষা চর্চা করে, তারা ইসলামী সংস্কৃতির প্রভাব এই ভাষাতে সৃষ্টি করতে পারে। অনেক মুসলিম কবি যুগ যুগ ধরে সাহিত্য চর্চা করেছেন বাংলা ভাষায়। কাজি নজরুল ইসলাম পবিত্র কুরআনের বাংলা অনুবাদ কাব্যে রচনার কাজ শুরু করেছিলেন। তিনি অসুস্থ হওয়ার কারণে তা পূর্ণ করতে পারেননি। শুধু আমপারা কাব্যে অনুবাদ সমাপ্ত করেছেন । যা ইসলামিক ফাউন্ডেশন হতে প্রকাশিত হয়েছে। একইভাবে কবি ফররুখ সহ আরো অনেক কবি ও সাহিত্যিক বাংলা ভাষায় ইসলামী ভাবধারাকে প্রচার করেছেন। বাংলা ভাষা চর্চা করা মুসলমানদের জন্য আবশ্যক এবং বাংলাতে ইসলামী ভাবধারাকে প্রচার করা ও ইসলামী সংস্কৃতির সাথে সম্পৃক্ত করা তাদের কর্তব্য
একুশ নয় ৮ই ফাল্গুন :
২১শে ফেব্রুয়ারী যে মহান ব্যক্তিগণ শহীদ হয়েছেন সালাম, বরকত, আবদুল জব্বার প্রমুখ সকলে মুসলমান ছিলেন। তারা বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রীয়ভাষা করার জন্য তাদের আত্মাকে বিসর্জন দিয়েছেন। এই দিনে যেহেতু তারা বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন আমাদের উচিৎ ছিল শুরু থেকে এই দিন বাংলা তারিখে পালন করা । অথচ এখানেও আমরা অপসংস্কৃতিতে আচ্ছাদিত।
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী ছিল ৮ই ফাল্গুন । এই ৮ই ফাল্গুন প্রতি বছর মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করা দরকার, যাতে যেই ভাষার জন্য আমার ভাইয়েরা রক্ত দিয়েছেন সে ভাষার সাথে তারিখে সঙ্গতি থাকে । এখানেও আমাদের একটা মনস্তাত্ত্বিক দ্বগ্ধ কাজ করছে। একদিকে আমরা এই দিবসকে বাংলা ভাষার দিবস হিসেবে পালন করি, কিন্তু তা পালন করি ইংরেজী তারিখ অনুযায়ী ২১শে ফেব্রুয়ারী। অথচ পালন করা দরকার ছিল ৮ই ফাল্গুন ।