নবীজি স. এর জন্মের দিন যা ঘটেছিল - Nobijir Jonmer din-ja ghotesilo
12:29:33 12/03/2023
নবীজি স. এর জন্মের দিন যা ঘটেছিল: ইসলামের ইতিহাসে রবিউল আওয়াল হল গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস । ঐতিহাসিক একটি মাস । আকাশের কোণে যখন রবিউল আওয়াল মাসের চাঁদ দেখা যায়, তখন সারা বিশ্বের মুসলমানদের অন্তরে নতুন করে এক আন্দোলন শুরু হয় । মুসলমানদের এই আন্দোলন হল মুক্তির আন্দোলন। রাসূল (সাঃ) এর মুহাব্বত নতুন করে জাগ্রত হয় । কারণ, এই মাসে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার নবীকে দুনিয়ার বুকে প্রেরণ করেছেন। আল্লাহর নবীর দুনিয়ার বুকে আগমন ঘটেছে মাহে রবিউল আওয়ালে।
অধিকাংশ ঐতিহাসিকদের মতামত যে, তিনি রবিউল আওয়াল মাসেই দুনিয়াতে এসেছেন।' কাজেই এ মাস মিলাদুন্নবীর মাস, নবীর জন্মের মাস । ফলে এই মাস যখন আসে মুসলমানদের অন্তরে স্বাভাবিকভাবে মুহাব্বতে রাসূলের নতুন হাওয়া জাগে, তারা নতুনভাবে আন্দোলিত হয়। আমি যে বিষয়টি আপনাদের সামনে উপস্থাপন করতে চাই, তা হচ্ছে বছরের চাকা ঘুরেই রবিউল আওয়াল মাস প্রতি বছর আমাদের কাছে আসে। কিন্তু কি শিক্ষা আমাদের জন্য নিয়ে আসে। আমাদের কি করণীয় । এ মাসে নতুন করে আমরা কি শপথ গ্রহণ করতে পারি? আল্লাহর নবীর আদর্শের ব্যাপারে এই মাস আমাদের কাছে কি শিক্ষা বহন করে? ।
আলোকছটা
ঐতিহাসিক মতামত অনুযায়ী দেখা যায়, যে দিন মা আমেনার ঘরে সুবহে সাদিকের সময় আল্লাহর রাসূলের আগমন ঘটবে কয়েকজন মহিলা তার ঘরের মধ্যে উপবিষ্ট ছিলেন । তারা হঠাৎ করে দেখলেন, আকাশ থেকে সরাসরি যেন এক আলো পুরা ঘরকে আচ্ছাদিত করে ফেলেছে, আলোয় ঝলমল করে উঠল পুরা ঘর । মহিলারা অবাক হল । দুনিয়ার বুকে প্রতিদিন কত শিশু, কত সন্তানের আগমন ঘটছে, ঘরে ঘরে নতুন শিশুর আগমন হয়, এমনতো আমরা কোন দিন দেখিনি। তারা হঠাৎ আকাশের দিকে তাকাল, তাদের কাছে মনে হলো আকাশের তারাগুলো যেন ঝুঁকে পড়ছে আর ঘরটা যেন আলোর বন্যায় ভাসছে ।
পারস্যের সাম্রাজ্যে নাড়া
আল্লাহর নবী যেদিন দুনিয়ার বুকে আসেন পারস্যের সাম্রাজ্য যা ছিল বিশাল এক সাম্রাজ্য, একটি পরাশক্তি। তাদের সম্রাটের থাকার জন্য যে প্রাসাদ, যে বিশাল ঘর, তা ছিল প্রাচীন একটি প্রাসাদ, ঐতিহ্যবাহী একটি ঘর। পারস্য সম্রাটের প্রাসাদ হঠাৎ করে নড়ে চড়ে উঠল এবং ১২টি পাথর সে প্রাসাদ থেকে খসে পড়ে গেল। তারা অবাক হল, এত সুরম্য প্রাসাদ, সুন্দর প্রাসাদ হতে হঠাৎ করে ১২টি ইট পড়ে গেল কেন? কারণ কি?
সম্রাটের স্বপ্ন
পারস্যের সম্রাট রাতে স্বপ্নে দেখেন, আরব মরুভূমি থেকে কিছু উট এবং সামনে একটি ঘোড়া ধেয়ে আসছে। শক্তিশালী একটি ঘোড়া আরবের কিছু উটকে টেনে মরুভূমি থেকে নিয়ে আসছে, ফুরাত নদী পার হয়ে পারস্যের বিভিন্ন সাম্রাজ্যে তারা ছড়িয়ে পড়ছে । তাদের সাম্রাজ্য বেদখল হয়ে যাচ্ছে। আজগবি এই স্বপ্ন দেখে ঘুম থেকে জাগ্রত হলেন, স্বপ্নের ব্যাখ্যাকারকে তিনি ডাকলেন এবং খ্রীষ্টান ধর্মের বড় পাদ্রীদেরকে ডাকা হল। সম্রাট বললেন- রাতে ভয়ংকর এক স্বপ্ন দেখে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেছে ।
আপনাদের কাছে আমি স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে চাই । তারা জিজ্ঞাসা করল আপনি কি স্বপ্ন দেখেছেন? সম্রাট বলল, রাতের বেলায় আমি ঘুমিয়েছিলাম, আমি দেখতে পেলাম, আরব মরুভূমি থেকে একটি বিশাল উটের পাল আসছে। সামনে শক্তিশালী একটি ঘোড়া উটের পালকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। মরুভূমি থেকে ফুরাত নদী পার হয়ে পুরা পৃথিবীর মধ্যে ছেয়ে গেছে । আমাদের সাম্রাজ্যকে তারা দখল করে ফেলেছে । এই স্বপ্ন ভয়ঙ্কর । এই স্বপ্ন দেখে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল ।
স্বপ্নের ব্যাখ্যা
আরবজাতি ছিল তখন বিভক্ত, কেন্দ্রীয় কোন নেতৃত্ব আরবদের মাঝে ছিলনা । কেন্দ্রীয় সরকার আরবে ছিলনা, সকল গোত্র পৃথকভাবে বাস করত। পুরা আরবজাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে পারস্য সাম্রাজ্য দখল করে ফেলবে, এটা তারা কল্পনাও করতে পারেনি। রাজনীতির বিশ্লেষণ বলছে, আরবরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে পারস্য সাম্রাজ্য'র উপর আঘাত করবে এটা কল্পনাও করা যায়না । কিন্তু এই স্বপ্ন আমি কেন দেখলাম, আপনারা ব্যাখ্যা বলুন। তারা বলেছে যে, আরবের মধ্যে আজ রাতে এক শিশুর জন্ম হচ্ছে যেই শিশুর নেতৃত্বে পুরা আরব জাতি ঐক্যবদ্ধ হবে । শুধু আরব জাহানে নয়, আরবদ্বীপে নয় সারা পৃথিবীতে এমনকি পারস্যের বিশাল সাম্রাজ্য তার নেতৃত্বে তারা দখল করে নেবে এবং তারা তাদের আদর্শের পতাকাকে উড্ডীন করবে, এ হচ্ছে আপনার স্বপ্নের ব্যাখ্যা ।
এক ইহুদীর অনুভূতি
একজন ইহুদী বলল, আমার মনে হচ্ছে আজকে আরবজগতে কোন একজন বিশেষ শিশুর জন্ম হয়েছে। লোকজন জিজ্ঞেস করল আপনি কি করে বুঝলেন যে, আজকে আরবের মধ্যে একজন শিশুর জন্মলাভ হয়েছে । ইহুদী বলল- আমি রাতের বেলায় তারকাগুলোকে দেখলাম ঝুঁকে পড়ছে, আকাশ থেকে আরবের উপর আলোর বিচ্ছুরণ আমি দেখতে পেয়েছি। আমার মনে হচ্ছে আরবের মধ্যে কোন মহান পুরুষের জন্ম হয়েছে। সকলে বলল- আমরাতো জানিনা, তবে খোঁজ করে দেখা যায়। মক্কা নগরীতে তারা খোঁজ করে দেখতে পেল যে, আজ রাতে আব্দুল মুত্তালেবের ঘরে এক শিশুর জন্ম হয়েছে। তারা এসে ইহুদীকে খবর দিল হ্যাঁ, আমরা খোঁজ নিয়ে দেখেছি, আব্দুল মোত্তালেবের ঘরে একটি শিশুর জন্ম হয়েছে, ইহুদী বলল- আমি দেখতে চাই সে শিশুকে ।
ইহুদী প্রাচীন কিতাব থেকে সর্বশেষ নবীর যে নিদর্শন জানত সেগুলো তেলাওয়াত করে জেনে নিল যে, সর্বশেষ নবী যে দিন দুনিয়ার বুকে আসবেন তখন কি কি ঘটনা ঘটবে তার কি চিহ্ন থাকবে । ইহুদী আব্দুল মোত্তালেবের ঘরে আসল । এসে নবজাতক শিশুর দিকে তাকাল, কেউ বুঝতে পারেনি, সকলের কাছে মনে হচ্ছে, অন্য একজন শিশুর মত শিশু। কিন্তু ইহুদী বলল, আমি শিশুর পিঠ দেখতে চাই । দু’ঘাড়ের মাঝখানে তিনি দেখতে পেলেন মোহরে নবুওয়াত, এক ধরনের বিশেষ চিহ্ন। আগের কিতাবের মধ্যে বলা হয়েছে সর্বশেষ নবী যখন দুনিয়ার বুকে আসবে তার পিঠের মাঝখানে একটি সিলমোহর থাকবে ।
এটাকে কিতাবের ভাষায় খতমে নবুওয়াত, নবুওয়াতের সীল বলা হয় । ইহুদী তা দেখে বেহুশ হয়ে পড়ে গেল। অনেকক্ষণ পর তার যখন হুশ আসল, তখন লোকজন জিজ্ঞেস করল কি ব্যাপার আপনি এই শিশুকে দেখে বেহুশ হলেন কেন? লোকটি বলল- আমি বেঁহুশ হয়েছি দুটি কারণে, প্রথমত: আমি আনন্দিত এ জন্য যে, এ নিয়ে সর্বশেষ নবীর আগমন ঘটেছে। অপরদিকে আমি অত্যন্ত দুঃখিত এজন্য অন্ধকারাচ্ছন্ন জাহেলিয়াত প্লাবিত বর্বরতাপূর্ণ এই পৃথিবীর বুকে আলোর মশাল
পৃথিবীর সকলেই ছিল বনী ইসরাঈল গোত্রের । ইহুদী- খ্রীষ্টানদের সব নবী ছিলেন হযরত ইয়াকুব (আঃ) এর সন্তান। ইয়াকুব (আঃ), হযরত দাউদ (আঃ), সুলাইমান (আঃ), মুসা (আঃ) সহ নবীদের বিশাল বহর ছিলেন বনী ইসরাঈল গোত্রের। আমরা প্রত্যাশায় ছিলাম যে, সর্বশেষ নবীর আগমন ঘটবে ইসরাঈল গোত্রে, আমাদের বংশে, আমাদের ধারাবাহিকতায়। কিন্তু আমি অবাক হলাম, আরব মরুভূমিতে তার আগমন ঘটল কি করে? সর্বশেষ নবুওয়তের যে গৌরব সেটা বনী ইসরাইলের মানুষরা পেলনা। এজন্য মনটা খুবই ব্যথিত হয়েছে। আর এই ব্যথাকে সহ্য করতে না পেরে আমি বেঁহুশ হয়ে গেলাম।
অগ্নিমন্ডপ নিভে গেল
আল্লাহর নবীর আগমনে পারস্য সম্রাটের প্রাসাদ নড়ে উঠল, পাথর খসে পড়ল। ইরানের অগ্নী পুজারীদের অনেক দিনের অগ্নি মশাল ছিল। তারা সেটাকে জ্বালিয়ে রাখত এবং তারা তার পূজা করত। দুনিয়ার বুকে আল্লাহর নবীর আগমন ঘটার সাতে সাথে অগ্নি পূজারীদের আগুনের মন্ডপ নিভে গেল । তারা অবাক হল, শত শত বছরের আগুনের মন্ডপ যা একদিনের জন্যও নিভেনি আজকে হঠাৎ কেন নিভে গেল। গণকরা তাদের বলল- এই বিশ্বে কোন একটি পরিবর্তন হচ্ছে, হচ্ছে একটা বিপ্লব । নতুন কোন ব্যক্তির, মহান কোন পুরুষের আগমন হচ্ছে সে কারণে অগ্নিকান্ড নিভে গিয়েছে, পূজা বন্ধ হয়ে গেল এক দিনের জন্য । আল্লাহর নবীর আগমন একটি বিপ্লব সৃষ্টি করেছে ।
ইহুদী-খ্রীষ্টানদের আস্তানায় আঘাত, অগ্নিপূজারীদের আস্তানায় আঘাত, জনগণের উপর অত্যাচারী পারস্য সম্রাজের উপর আঘাত । আল্লাহর নবী এখনও দাওয়াত শুরু করেননি। দ্বীনের দাওয়াত ও তাঁর আদর্শের দাওয়াত শুরু করেননি, কেবল তার আগমনে সারা পৃথিবীর মধ্যে বিপ্লব ঘটল । বাতেলের বড় বড় শক্তির উপর আল্লাহর নবীর আগমন আঘাত সৃষ্টি করল । সবগুলো নড়ে চড়ে উঠল। পারস্য সাম্রাজ্য থেকে শুরু করে ইরানের অগ্নি মন্ডপ পর্যন্ত সবগুলোর মধ্যে পরিবর্তন দেখা গেল ।
মীলাদের শিক্ষা
মহানবীর মীলাদ আমাদেরকে এই শিক্ষা দান করে, বাতিলের সামনে হক্ক যখন আসবে, সত্য যখন আসবে, বাতিল অপসারিত হতে বাধ্য হবে ।
جاء الحق وزهق الباطل أن الباطل كان زهوقا
“সত্য সমাগত, মিথ্যা অপসারিত আর মিথ্যা অপসারিত হতে বাধ্য।” সূর্যের আগমন ঘটলে যেমন অন্ধকার বিদূরিত হয়ে যায়, অপসারিত হয়ে যায়, অন্ধকার আর থাকতে পারেনা, ঘরের কোণ থেকেও অন্ধকার চলে যায় আল্লাহর নবীর আগমনের কারণে সকল বাতিল শক্তি অপসারিত হতে লাগল । যখনি আল্লাহর নবীর আগমনের এই মাস আসবে তখন আল্লাহর নবী প্রেমিকদের মাঝে নতুন করে সত্যের পক্ষে অবিচল থাকার প্রেরণা সৃষ্টি করবে। রবিউল আউয়ালের বার্তা এটাই যে, তোমাদের নবীর যে দিন আগমন সেদিন বাতিলের উপর আঘাত হয়েছিল, শিরকের উপর আঘাত হয়েছিল, শিরকের বড় বড় কেন্দ্রগুলি নড়ে উঠেছিল ।
রবিউল আওয়াল মাসের বার্তা হল, আল্লাহর নবীর যারা উত্তরসূরী, আল্লাহর নবীর আদর্শের যারা প্রেমিক তারাও প্রতিটি মুহুর্তে শিরকের বিরুদ্ধে উচ্চ কণ্ঠ থাকবে । কুফরের বিরুদ্ধে, বাতিলের বিরুদ্ধে উচ্চ কণ্ঠ থাকবে এবং হক্বকে তারা আঁকড়ে ধরবে। হজ্বের আলোকে তারা পৃথিবীল বুকে প্রচার করবে। এটাই হচ্ছে রবিউল আওয়ালের বার্তা বা Massage।