বাংলা বানান শেখার নিয়ম - Rules for learning Bengali spelling
05:09:48 12/04/2023
বাংলা বানান শেখার নিয়ম : আশা করি সবাই ভালো আছো। আমি ভালো থাকতে চেষ্টা করি, কিন্তু পারি না, তোমাদের কারণে। কথাটা মিথ্যে নয়। তোমাদের লেখায় যখন বানানের আশ্চর্য রকম অশুদ্ধতা দেখি তখন সত্যি সত্যি আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। তাই এখানে কলম মেরামত প্রসঙ্গে প্রথমেই বানান সম্পর্কে কিছু কথা বলবো।
যে কোন ভাষায় বিশুদ্ধ বানানের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোন শিক্ষিত মানুষ বানান ভুল করবে এটা কল্পনা করাও সম্ভব নয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, আমরা যারা মাদরাসায় পড়ি, মাতৃভাষায় আমাদের বানান ভুল লজ্জাজনক পর্যায়ে বেশী। অবশ্য এটাও ঠিক যে, ইংরেজী বর্ষপঞ্জীর ফেব্রুয়ারী মাসের একুশ তারিখে যারা শহীদ মিনারে ফুল দেয় এবং শহীদদের আত্মার শাস্তি কামনা করে নাচ-গান ও নাটক মঞ্চস্থ করে তাদের বাংলা বানানের অবস্থাও যথেষ্ট কাহিল। কিন্তু আমার কথা হলো, আমরা আত্মসমালোচনা করতে চাই।
অন্যদের কী অবস্থা সেটা আমাদের আলোচ্যবিষয় নয়। বাংলাভাষার প্রতি অন্যদের কোন দায় নেই। কিন্তু আমরা দ্বীনি দিক থেকে বাংলাভাষার কাছে দায়বদ্ধ। কেননা আমরা বাংলা শিখতে চাই এ জন্য যে, বাংলাভাষার মাধ্যমে আমরা দ্বীনের খেদমত করবো। বাংলাভাষাকে আমরা আমাদের নিয়ন্ত্রণে রাখবো, যাতে শয়তানের অনুচরেরা বাংলাভাষাকে হকের বিরুদ্ধে বাতিলের বাহনরূপে ব্যবহার করতে না পারে। অন্তত ফাঁকা মাঠে একাই যেন বাঁশি বাজাতে না পারে।
আমাদের বাংলাভাষা চর্চা হলো ইবাদত, আমরা চাই বাংলাভাষার নেতৃত্বের আসনে সমাসীন হতে । সুতরাং সে ভাবেই আমাদেরকে বাংলাভাষা শিখতে হবে। তাই এখন থেকে আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক-
সাহিত্য আমরা যে যে পরিমাণই শিখি না কেন, অন্তত বাংলা বানানে আমরা নির্ভুল হবো ।
আচ্ছা চলো, 'ভূল' শব্দটাকেই আগে শুদ্ধ করি
আমার কাছে যত লেখা ও চিঠি আসে তার বেশির ভাগেই 'ভূল' থাকে। এ ভুলটা যেন আমরা কেউ আর না করি।
পরে কোন এক অবকাশে তোমাদের লেখা ও চিঠিপত্রের বানান শুদ্ধির একটা বড় সড় অভিযান চালানোর ইচ্ছা আমার আছে।
এ মজলিশে শুধু বানান সম্পর্কে দু'একটা নিয়ম তোমাদের বলবো।
মূর্ধন্য শব্দটি এসেছে 'মূর্খা' থেকে। এ শব্দের আভিধানিক অর্থ মস্তক বা অগ্রভাগ। ব্যাকরণের পরিভাষায় মূর্ধন্য অর্থ জিহ্বার অগ্রভাগকে তালুতে সৃষ্ট করে উচ্চার্য বর্ণ ।
ঋ, ট, ঠ, ড, ঢ, ণ, র, ষ এই আটটি বর্ণ হলো 'মূর্ধন্য পরিবারভুক্ত বর্ণ'। 'ণ ও য' এ দুটি বর্ণের সাথেই শুধু মূর্ধন্য শব্দটা প্রযুক্ত হয়, যাতে 'স ও ন' থেকে এ দুটিকে পৃথকভাবে চিহ্নিত করা যায়। নইলে প্রকৃতপক্ষে মূর্ধন্য বর্ণ হচ্ছে মোট আটটি।
যা হোক মূর্ধন্য-ণ ও মূর্ধন্য ষ নিয়ে সবাইকে বেশ হিমশিম খেতে দেখা যায়। অথচ কয়েকটা নিয়ম জেনে নিলে অন্তত আশি ভাগ ক্ষেত্রে 'মূর্ধন্য- সমস্যা' থেকে আমরা রেহাই পেতে পারি। এ সম্পর্কে বিভিন্ন ব্যাকরণ গ্রন্থে যে সকল বানান নিয়ম দেয়া হয়েছে সেগুলোকে এখানে আমরা সহজ ভাষায় তোমাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
(১) র, ঋ, রেফ, র-ফলা ও ষ-এর পরে ন-এর পরিবর্তে ণ হয়। যদি মাঝে স্বরবর্ণ, প-বর্গ (প-ফ-ব-ড-ম) এবং 'য়'- 'হ' ছাড়া অন্য কোন বর্ণ থাকে তাহলে ন হবে। উদাহরণ দেখো- চরণ, বরণ, মরণ, হরণ, করণ, কারণ, কিরণ, রোপণ, পরায়ণ ইত্যাদি ।
ঋণ, মসৃণ, তৃণ, ঘৃণা, মৃয়মাণ, কৃপণ ইত্যাদি। বর্ণ, বর্ণ, চূর্ণ, অর্পণ, নির্মাণ, অনির্বাণ, প্রাণ, ত্রাণ, ঘ্রাণ, ব্রণ, গ্রহণ, প্রমাণ, প্রবীণ, গ্রামীণ ইত্যাদি। একজন লিখেছে, 'দুশমনের উপর 'আক্রমন' চালাও। আমি মন্তব্য করেছিলাম, তোমার 'আক্রমনে' কোন ধার নেই। 'ন' এর কারণে ধার নষ্ট হয়ে গেছে। তাছাড়া তোমাকে শত্রুর উপর আক্রমণ করতে হবে, আর দুশমনের উপর হামলা চালাতে হবে। ভাষণ, তোষণ, আকর্ষণ, চোষণ ইত্যাদি। তুমি যদি 'চোষন' দাও তাহলে সারাদিন চুষলেও সামান্য রসও বের হবে না।
ভক্ষণ, বিচক্ষণ, প্রদক্ষিণ, ক্ষীণ, লক্ষণ, ক্ষীয়মাণ ইত্যাদি শব্দগুলোতে ণ হলো কেন? কারণ ক্ষ বর্ণটি যুক্তবর্ণ, যথা, ক+ষ= ক্ষ। সুতরাং ষ-এরপর ণ হয়েছে। রচনা, রসনা, রত্ন, রুগ্ন ইত্যাদি শব্দগুলোতে র-এর পর ন হয়েছে। কেননা মাঝে স্বরবর্ণ, প-বর্গ এবং য় ও হ ছাড়া অন্য বর্ণ এসেছে। যথা চ, স, ত, গ। অর্জন, নির্বাচন, দর্শন, প্রবর্তন ইত্যাদি শব্দে রেফ-এর পর একই কারণে ন হয়েছে।
প্রবচন, প্রাচীন, প্রয়োজন, প্রধান ইত্যাদি শব্দগুলোতে একই কারণে র-ফলা এর পর ন হয়েছে।
মনে রাখতে হবে যে, এ নিয়ম মুফরাদ শব্দের বেলায় শুধু খাটবে, মুরাক্কাব বা যুক্তশব্দের বেলায় খাটবে না। তাই দুর্ণাম নয়, দুর্নাম এবং ত্রিণয়ন নয়, তাত্রিনয়ন। কারণ 'দুঃ' এই উপসর্গ যুক্ত হয়ে দুর্নাম হয়েছে। আর নয়নের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ত্রি। সুতরাং এরা হচ্ছে যুক্ত শব্দ।
প্রবীণ ও নবীন শব্দদুটি লিখতে অনেকেই ভুল করে, আশা করি উপরের নিয়মটি জেনে নেয়ার পর তোমাদের আর ভুল হবে না।
পূর্বাহ্ণ, মধ্যাহ্, অপরাহ্ এ তিনটি হলো দিবসের তিনটি সময়ভাগের নাম। প্রথম ও তৃতীয়টিতে ণ আর মাঝেরটিতে ন, কারণ আশা করি তুমি বুঝতে পেরেছো।
আমরা অনেকে হারুণ, ইমরাণ, কামরাণ লিখি, এগুলো বিদেশী শব্দ, তাই ন হবে, ণ হবে না। হুমীরন বিবি সম্পর্কেও একই কথা।
(২) ট, ঠ, ড- এর সাথে যুক্ত অবস্থায় ণ হয়। যেমন- কণ্ঠ, কুণ্ঠা, লণ্ঠন, অবগুণ্ঠন, বণ্টন, হণ্টন, ঘণ্টা, পশু, প্রচণ্ড, ডাণ্ডা, পাণ্ডা ইত্যাদি ।
তবে বিদেশী শব্দের ক্ষেত্রে ন হবে। যেমন সেকেন্ড, ফান্টা, হান্টার, ক্যালেন্ডার ইত্যাদি।
(৩) ট বর্গের আগে সর্বদা ষ হয় যথা- মিষ্টি, বৃষ্টি, স্পষ্ট, নষ্ট, সুষ্ঠু, বলিষ্ঠ, কনিষ্ঠ ইত্যাদি ।
তবে বিদেশী শব্দে স বা শ হবে। যেমন- মাস্টার, স্টেশন, পোস্টার ইত্যাদি। একটি বড় মাদরাসায় নামফলকে বড় বড় হরফে লেখা রয়েছে 'ওয়াকফ ষ্টেট'। অথচ 'স্টেট' শব্দটা বিদেশী। দেশের বড় বড় ও নামী দামী প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডেও এই ভুলটি দেখা যায়। তোমরা শহরের সাইনবোর্ডগুলোতে একটু অনুসন্ধানী দৃষ্টি দিলেই অনেক 'সুস্বাদু' অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারবে। একটি কলেজের খৃস্টান অধ্যক্ষকে আমি 'খৃষ্টান' লিখতে দেখেছি। আমি যখন তাকে বললাম, 'আপনি খাঁটি খৃস্টান নন, ভুল খৃষ্টান' তখন তিনি হতভম্ব হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। পরে আমি বিষয়টি তাকে বুঝিয়েছিলাম এবং তিনি মৃদু হেসে আমাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন।
কোন বিদেশী শব্দে 'ণ' হতে পারে না, অথচ আমাদের পুরোনো টাকার গায়ে "গভর্ণর ছিলো। আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করার পর তা সংশোধন করা হয়েছে।