জিহাদের সূচনা ও ইতিহাস
জিহাদের সূচনা ও ইতিহাস
হযরত হামজা ও হযরত উবায়দা রা. এর সারিয়া
নবী কারীম সা. এর জীবনের তেপ্পান্ন বছরের সংক্ষিপ্ত চিত্র পাঠকের সামনে এসে গেছে। তাতে স্বল্প বিস্তৃত এও উপলব্ধি করা হয়েছে যে, বিশ্বে ইসলাম প্রচার কিভাবে হয়েছে। প্রতিটি স্তর ও প্রতিটি গোত্রের হাজারো মানুষ যারা হিজরত পর্যন্ত ইসলামের দলে ভিড়ে এমন আসক্ত হয়েছিল যে, ইসলাম এবং ইসলামের পয়গম্বর সা. কে নিজেদের জান, মাল, বিষয় সম্পত্তি, বাপদাদা, ও সন্তানদের থেকে বরং নিজেদের জান থেকেও অধিক প্রিয় মনে করত। তাদের ইসলামে প্রবেশের কি কারণ ছিল? রাষ্ট্রীয় বাধ্য-বাধকতা বা সম্পদের লোভ ও পদমর্যাদার লালসা বা ক্ষমতার দাপট, যার তরবারি তাদেরকে বাধ্য করেছিল, না অন্য কিছু? কিন্তু যখন এই উম্মী নবী (তার উপর পিতা মাতা কুরবান হোক) সা. এর পবিত্র জীবন চরিতের উপর দৃষ্টি দেয়া হয় তখন নিঃসন্দেহে এসবের উত্তর নেতিবাচক আসবে।
সাস্থসম্মত উপায়ে তৈরি ১০০%-খাঁটি-ঘি
এটা দিবালোকের মত স্পষ্ট যে, ওই ইয়াতীম তাঁর পিতৃছায়া পৃথিবীতে আসার পূর্বেই তাঁর মাথা থেকে উঠে গেছে, যার শৈশবকালের ছয় বছর বয়সে মাতৃস্নেহ হারিয়ে গেছে। যার গৃহে মাসের পর মাস আগুন জ্বলার সুযোগ হত না। যার পরিবারের লোকেরা কোন সময় পেট ভরে খেতে পারত না। যার নিকটাত্মীয়রাও এ সত্য কালিমা বলার কারণে শুধু তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেনি বরং তার প্রাণনাশক শত্রুতে পরিণত হয়েছে। তিনি কি কারো উপর রাজত্ব করতে পারতেন মালের লোভে বা তরবারির জোরে কাউকে নিজ মতালম্বী বানাতে পারতেন।
এছাড়া ইতিহাসের বিশাল ভাণ্ডার আমাদের সামনে আছে, যাতে মতপার্থক্য ছাড়া বর্ণিত আছে যে, মহানবী সা. এর বয়সের তেপ্পান্ন বছর এমনভাবে অতিবাহিত হয়েছে যে, প্রথম জীবন সহায় সম্বল ও সাহায্যকারীহীন হওয়ার পর যখন ইসলামের সামান্য বাহ্যিক শক্তিও অর্জন হয়েছিল এবং বড় বড় বীর-বাহাদুর ও ধনী সাহাবী ইসলামে প্রবেশ করেন। সে সময়ও ইসলাম কোন কাফেরের উপর হাত উঠায়নি; বরং অত্যাচারীদের অত্যাচারের জবাবও দেয়নি।
অথচ, কাফেরদের পক্ষ থেকে মহানবী সা. এর উপর বরং তার সাথে সংশ্লিষ্ট সকল পরিবার ও অনুসারীদের উপর এমন জুলুম-নির্যাতন করা হয়েছে, যা বর্ণনাতীত এবং লেখা অসম্ভব। কুরাইশ কাফেররা যারা সব ধরনের শক্তি ও দাপট রাখত, মহানবী সা. কে কষ্ট দেয়া বরং তাকে হত্যা করার জন্য কোন সম্ভব্য মুহূর্ত হাত ছাড়া করেনি। যেমন- তিন বছর পর্যন্ত মহানবী সা. নিজ সঙ্গী- সাথীবৃন্দসহ অবরুদ্ধ থাকা, মহানবী সা. এর সাথে সমস্ত কুরাইশদের পরিপূর্ণ বয়কট করা, তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র, সাহাবায়ে কিরামকে সর্ব প্রকার কষ্ট দেয়া ইত্যাদি ইত্যাদি আপনারা জেনে এসেছেন।
এসব কিছু সত্ত্বেও কুরআন নিজ অনুসারীদেরকে ধৈর্য ও অবিচলতা অবলম্বন ছাড়া কোন যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দেয়নি। হ্যাঁ, সে সময় যে জিহাদের অনুমতি ছিল সেটা হল কাফেরদেরকে প্রজ্ঞা এবং উপদেশ বাণীর মাধ্যমে নিজ প্রভুর দিকে আহবান কর। যদি পরস্পর কথা বলার সুযোগ আসে তাহলে সুন্দর পন্থায় এবং নরম কথা দ্বারা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। কুরআনের সুস্পষ্ট প্রমাণ দ্বারা তাদের সাথে সর্বাত্বক জিহাদ কর, যাতে তারা সত্য বুঝতে পারে।
ঐ সময় পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষ যারা ইসলামের অনুসারী হয়ে সব ধরনের বিপদের লক্ষ্যবস্তু হওয়ার উপর রাজি হয়ে যান। এ কথা স্পষ্ট যে, তারা কোন পার্থিব লোভ বা রাজ্যের বাধ্য বাধকতা বা তরবারির জোরে বাধ্য হননি। ঐ সমস্ত মানুষ কি এই সুস্পষ্ট নিদর্শন দেখার পরও আল্লাহ থেকে লজ্জা করবে না? যারা ইসলামের সত্যতা ঢাকার জন্য বলে থাকে যে, ইসলাম তরবারির জোরে প্রসার লাভ করেছে। তারা কি এর কোন সদুত্তর দিতে পারে যে, ঐ সমস্ত তরবারি চালকদের উপর কারা তরবারি চালিয়েছে? যারা শুধু মুসলমান হননি বরং ইসলামের সাহায্যার্থে তরবারি ধরতে এবং নিজ জান শংঙ্কার মধ্যে ফেলতে রাজি হয়েছিলেন।
তারা কি এটা বলতে পারে যে, আবু বকর সিদ্দিক, হযরত উমর ফারুক, হযরত উসমান গনী, হযরত আলী মুরতাজা রা. এর উপর কে তরবারি চালিয়ে মুসলমান বানিয়েছে? আবু যর, উনাইস, এবং তাদের গোত্রকে কে বাধ্য করেছিল যে, তারা সবাই এসে ইসলামে প্রবেশ করল। নাজরান এলাকার খৃস্টানদেরকে কে বাধ্য করেছিল, যারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে মক্কায় উপস্থিত হয়ে মুসলামন হয়েছিল। দমাদ আযদীকে কে বাধ্য করেছিল? তুফাইল ইবনে আমর দাউসী এবং তার গোত্রর উপর কে তরবারি উঁচিয়ে ধরেছিল? বনী আব্দুল আশহাল এর গোত্রদের উপর কে চাপ সৃষ্টি করেছিল? মদীনার আনসারদের উপর কার প্রভাব ছিল, যারা শুধু ইসলামই গ্রহণ করেননি বরং মহানবী সা. কে সেখানে ডেকে এনে সকল দায় দায়িত্ব নিজেরদের মাথার উপর নিলেন এবং নিজেদের জান-মাল নবীজী সা. এর উপর উৎস্বর্গ করলেন? বুরাইদা আসলামীকে কে বাধ্য করেছিল,যে সত্তরজন লোকের একটি কাফেলা নিয়ে মদীনার রাস্তায় মহানবী সা. এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে সন্তুষ্টি ও আগ্রহের সহিত মুসলমান হয়ে যান।
আবিসিনিয়ার বাদশাহ নাজ্জাশীর উপর কোন তরবারি পরিচালিত হয়েছিল, যিনি নিজের সাম্রাজ্য ও দাপট থাকা সত্ত্বেও হিজরতের পূর্বেই মুসলমান হয়েছিলেন? আবু হিন্দ, তামীম, নাঈম প্রমুখের উপর কে শক্তি প্রয়োগ করেছিল, যারা সিরিয়া থেকে সফর করে মহানবী সা. এর খেদমতে পৌঁছে তার দাসত্ব বরণ করে নিলেন? এ ধরনের শত শত ঘটনা আছে, যদ্বারা ইতিহাস গ্রন্থ ভরপুর। এগুলো অনস্বীকার যোগ্য চাক্ষুষ সাক্ষী। যেগুলো দেখে প্রত্যেক মানুষ এ বিশ্বাস না করে থাকতে পারে না যে, ইসলাম প্রচার-প্রসারে তরবারির মুখাপেক্ষী নয় ।
জিহাদ ফরয হওয়ার দ্বারা এ উদ্দেশ্য নয় যে, লোকদের ঘাড়ে তরবারি রেখে বলা হবে যে, মুসলমান হয়ে যাও বা তাদেরকে শক্তি প্রয়োগ বা বাধ্যতামূলক ভাবে ইসলামে প্রবেশ করানো হবে। জিহাদের সাথে সাথে জিযিয়ার বিধান এবং কাফেরদেরকে জিম্মি বানিয়ে তাদের জান মালের হিফাজত ঠিক মুসলমানদের মতো করা সম্পর্কে নিয়মকানুনগুলো স্বয়ং একথার সাক্ষী যে, জিহাদ ফরয হওয়া সত্ত্বেও কখনো কাফেরকে আগে ইসলাম কবুল করতে বাধ্য করেনি। এজন্য একজন ন্যায়বান স্বভাবের মানুষের দায়িত্ব হল, শান্ত মনে একথা চিন্তা করবে যে, ইসলামে জিহাদ ফরয হয়েছে কোন উদ্দেশ্যে এবং কি উপকারার্থে। ঐ সময় তার বিশ্বাস কার লাগবে যে, যেমনিভাবে ঐ ধর্ম পূর্ণাঙ্গ মনে করা হয় না, যা লোকদের গলা টিপে শক্তি প্রয়োগ ও বাধ্যতামূলকভাবে নিজেদের দলে ভিড়ায়। এমনিভাবে ঐ ধর্মও পরিপূর্ণ নয়, যাতে রাজনীতি নেই
ঐ রাজনীতি পরিপূর্ণ নয়, যাতে তরবারি নেই। ঐ ডাক্তার বিজ্ঞ নন, যিনি শুধু পট্টি লাগাতে পারেন; কিন্তু গলিত পচা ও নষ্ট অঙ্গগুলোর অপারেশন করতে পারেন না ।
আরব জোটে থাক বা অনারব জোটে,
যদি কলমের সাথে না থাকে তরবারি, ফায়দা হবে না মোটে।
বুঝে নাও খুব ভাল করে বুঝে নাও। যখন পৃথিবীর দেহে শিরকের বিষাক্ত জীবাণু সৃষ্টি হল এবং তা এক রুগ্ন দেহের ন্যায় হয়ে গেল, তখন আল্লাহর রহমতে তার জন্য এক সংশোধনকারী স্নেহশীল ডাক্তার (মহানবী সা. ) পাঠালেন। যিনি একাধারে তেপ্পান্ন বছর পর্যন্ত তার প্রতিটি অঙ্গ ও শিরা- উপশিরার সংশোধনের চেষ্টা করলেন। যার মাধ্যমে সংশোধন যোগ্য অঙ্গগুলো সুস্থ হয়ে গেল। কিন্তু কিছু অঙ্গ যা একেবারে পঁচে গিয়েছিল, সেগুলো ভাল করার কোন পন্থা ছিল না, বরং আশংকা ছিল যে, সেগুলোর বিষ সারা শরীরে ছড়িয়ে যাবে। এজন্য প্রজ্ঞাপূর্ণ নিয়ম অনুযায়ী দয়া ও প্রজ্ঞার সঠিক চাহিদা এটাই ছিল যে, অপারেশন করে সেই অঙ্গগুলোকে কেটে ফেলা হোক। এটাই জিহাদের বাস্তবতা এবং ইহাই সমস্ত আঘাত ও প্রতিরোধমূলক যুদ্ধের উদ্দেশ্য।
এটাই কারণ রণাঙ্গন উত্তাপ্ত হওয়ার সময়ও ইসলাম তার প্রতিপক্ষের সে সব লোকদের হত্যার অনুমতি দেয় যাদের রোগ সংক্রামক ছিল। অর্থাৎ ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা আঁটে ও প্রকাশ্যে যুদ্ধে নামে। আর তাদের সাথে সম্পৃক্ত নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও আলেম, যারা যুদ্ধে অংশ নেয় না তারাও সে সময় মুসলমানদের তরবারি থেকে নিরাপদ ছিল। বরং ঐ সমস্ত লোক যারা চাপে পড়ে বাধ্য হয়ে যুদ্ধে শরীক হয়েছে তারাও মুসলমানদের হাত থেকে নিরাপদ ছিল ।
হযরত ইকরামা রা. বলেন, বদর যুদ্ধে মহানবী সা. বলেছিলেন, বনী হাশেমের কোন ব্যক্তি তোমাদের সামনে আসলে তাকে হত্যা কর না। কেননা, তারা নিজ ইচ্ছায় যুদ্ধে আসেনি। বরং তাদেরকে জোরপূর্বক আনা হয়েছে।
বরং যুদ্ধের ময়দানে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত এবং যুদ্ধে অংশকারীদের মধ্য হতে যথাসম্ভব ঐ সকল লোকদের রক্ষার চেষ্টা করা হত যাদের সম্পর্কে নবী করীম সা. এর কাছে তাদের সচ্চরিত্র ও সদ্ব্যাবহারের সংবাদ আসত। নিম্নের ঘটনাটি আমাদের এ দাবীর পূর্ণ সাক্ষী ।
যখন মহানবী সা. মক্কা বিজয়ের জন্যে যাচ্ছিলেন তখন রাস্তায় এক ব্যক্তি মহানবী সা. এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে মহানবী সা. এর জিহাদকে আরবের বরবরযুগের যুদ্ধের সাথে অনুমান করে নিবেদন করল যে, যদি আপনি সুন্দর রমণী ও লাল উট চান তাহলে বনী মুদাল্লাজ গোত্রের উপর আক্রমণ করুন (কেননা, ঐ গোত্রে তা অধিক আছে) কিন্তু ইসলামে সন্ধি এবং যুদ্ধের উদ্দেশ্যই ভিন্ন ছিল। তিনি ইরশাদ করলেন, আল্লাহ তাআলা আমাকে বনী মুদাল্লাজের উপর আক্রমণ করতে নিষেধ করেছেন। কেননা, তারা আত্মীয়তা বজায় রাখে।
হযরত আলী রা. বর্ণনা করেন যে, একদা মহানবী সা. এর খেদমতে সাতজন যুদ্ধ বন্দীকে আনা হল। মহানবী সা. তাদেরকে হত্যার আদেশ করে হযরত আলীকে এ কাজের দায়িত্ব,দেন। তখন হযরত জিব্রাঈল আ. আগমন করে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! ঐ ছয়জনের জন্য তো এই আদেশ বহাল রাখুন। কিন্তু এই একজনকে ছেড়ে দেন। মহানবী কারণ জিজ্ঞেস করলেন। তখন হযরত জিব্রাঈল আ. বললেন, এ লোকটি উত্তম চরিত্রবাণ ও দানশীল মহানবী সা. তাঁকে বললেন, এট কি আপনি নিজের পক্ষ থেকে বলছেন না আল্লাহ তায়ালার আদেশ? জিব্রাঈল আ. বললেন, আল্লাহ তায়ালা আমাকে এমনই আদেশ করেছেন।
ইসলামী জিহাদ সভ্যতার দাবীদার ইউরোপ সম্প্রদায়ের বিশ্ব বিধ্বংসী যুদ্ধ ছিল না, যাতে কেবল নিজেদের কামনা-বাসনা চরিতার্থের জন্য নারী-পুরুষ ও অপরাধী- নিরপরাধী নির্বিচারে শহরের পর শহর নির্দয়ভাবে ধ্বংস করে দেয়া হয়। মরহুম কবি আকবার ইলাহাবাদ চমৎকার বলেছেন-
হচ্ছে ঘোষিত বিনাশের বাণী
ভাঙ্গিতেছে গৃহ নাশিতেছে জান,
কামান অসি পড়ছে রণাঙ্গনে
কুলুমান আলাইহা ফান ।
কিন্তু বাস্তব সত্য এই যে, মানুষ অন্যের চোখের বালুকণা তো দেখতে পায়; কিন্তু নিজ চোখের কড়িকাঠিও এড়িয়ে যায়।
কবি আকবার ইলাহবাদী রহ. আরো বলেছেন-
নিজ শত দোষের পরোয়া কোন নাহী।
দোষারোপ করে কহে অন্যেরে-
প্রসারিত হচ্ছে ইসলাম অসি জোরে ভবে
কামান বারুদে কি প্রসারিত হচ্ছে তা কহেনা উত্তরে।
মোটকথা,আত্মরক্ষামূলক ও আক্রমাণাত্নক জিহাদের একমাত্র লক্ষ্য হল উত্তম চরিত্রের প্রচার, ইসলাম সংরক্ষণ ও ইসলাম প্রচারের রাস্তায় যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছিল তা দূর করা ।
এসব ঘটনার প্রতি দৃষ্টি দেয়ার পর যেমনিভাবে সাধারণ ইউরোপীয়ান ঐতিহাসিক এবং মারগুলিউস প্রমুখের এ ধারণা একেবারে ভুল ও ডাহা মিথ্যা প্রমাণিত হয়ে যায় যে, ইসলামী জিহাদের লক্ষ্য জোরপূর্বক মানুষকে মুসলমান বানানো এবং লুট করে নিজেদের জীবিকার ব্যবস্থা করা ছিল। তেমনভাবে ইসলামী বর্ণনা এবং সাহাবীদের আচরণ একত্রিত করার পর এতে কোন সন্দেহ থাকে না যে, ইসলাম স্বীয় নিরাপত্তার লক্ষ্যে যেরূপ আত্মরক্ষামূলক জিহাদকে ফরয করেছে, তদ্রূপ ভবিষ্যতে তার ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও প্রচারের পথে প্রতিবন্ধকসমূহকে দূর করার লক্ষ্যে আক্রমাণাত্নক জিহাদকেও কিয়ামত পর্যন্ত অপরিহার্য ঘোষণা করেছে। যেমনিভাবে আত্নরক্ষামূলক জিহাদের লক্ষ্য লোকদেরকে জোর করে মুসলমান বানানো নয়, তদ্রূপ আক্রমণাত্নক জিহাদের উদ্দেশ্য কোনভাবেই এটা হতে পারে না।
বিশেষ করে যখন ইসলামের প্রশস্ত আঁচল ঠিক জিহাদের মুহূর্তেও কাফেরদেরকে নিজের আশ্রয়ে নেয় এবং কুফরের উপর অটল থাকা সত্ত্বেও তাদের জান, মাল, ইজ্জত-সম্মান ঐরূপই হিফাজতের জন্য বিছিয়ে রেখেছে, যেমনি একজন মুসলমালকে হিফাজত করা হয়। তাতে আত্মরক্ষা ও আক্রমণাত্ব মূলক জিহাদ উভয় সমান। এছাড়াও পৃথিবীতে প্রকৃত নিরাপত্তা ও শান্তি স্থাপন করা, দুর্বলদেরকে জুলুম থেকে মুক্তি দেয়া ইত্যাদি যা জিহাদের উদ্দেশ্য, তাতেও উভয় প্রকার এক সমান। এজন্য কোন কারণ নেই যে, ইসলামী বর্ণনাকে বিকৃত করে আক্রমণাত্নক জিহাদকে অস্বীকার করা হবে। যেমন আমাদের কিছু মুক্তচিন্তার ঐতিহাসিকগণ ধারণা করেছেন।
এই সংক্ষিপ্ত আলোচনার পর আমরা মূল লক্ষ্য শুরু করতে যাচ্ছি-
হিজরতের পর জিহাদ ও যুদ্ধের ধারাবাহিকতা শুরু হল। উহার কোনটায় মহানবী সা. স্বয়ং অংশ গ্রহণ করেছেন। আর কতকগুলোতে বিশেষ বিশেষ সাহাবীর নেতৃত্বে সৈন্য প্রেরণ করেছেন। ঐতিহাসিকদের পরিভাষায় প্রথম প্রকার জিহাদকে গাযওয়া আর দ্বিতীয় প্রকার জিহাদকে সারিয়া বলা হয়। গাযওয়ার মোট সংখ্যা তেইশ। এগুলোর নয়টাতে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল আর বাকীগুলোতে যুদ্ধ হয়নি। সারিয়া মোট তেতাল্লিশটি সংঘটিত হয়েছিল। আশ্চার্যের ব্যাপার যে, এসব গাযওয়া এবং সারিয়াগুলোতে মুসলমানদের সহায় সম্বলহীন ও সৈন্য সংখ্যা কম থাকা সত্ত্বেও সর্বদা বিজয় ও সাহায্য তাদের ভাগেই এসেছে। তবে শুধু উহুদ যুদ্ধে প্রথমে বিজয় লাভ করার পর মুসলমানরা পরাজিত হয়েছেন এবং তাও এজন্য যে, মুসলিম সৈন্যদের একটি অংশ মহানবী সা. এর নির্দেশ অমান্য করেছিল।
আমরা এসব গাযওয়া ও সারিয়াগুলোকে স্পষ্ট করার লক্ষ্যে চিত্রাকারে বৎসর পরিক্রমা অনুযায়ী লিপিবদ্ধ করে দিচ্ছি। যেহেতু গাযওয়া এবং সারিয়ার দিন তারিখ ও সংখ্যায় মতানৈক্য রয়েছে। এজন্য আমরা এ সব বর্ণনায় হাফেজে হাদীস আল্লামা মুগলতাঈর সীরাতের উপর নির্ভর করছি।
১ম হিজরী
এ হিজরীতে মহানবী সা. দু'টি সারিয়া প্রেরণ করেছিলেন। এক সারিয়ায়ে হামজা। দুই সারিয়ায়ে উবায়দা ।
২য় হিজরী
এ হিজরীতে পাঁচটি গাযওয়া হয়েছে।
এক. গাযওয়ায়ে আবওয়া, একে গাযওয়ায়ে ওদ্দানও বলা হয়। দুই. গাযওয়ায়ে বুয়াত. তিন. গাযওয়ায়ে বদরে কুবরা, চার. গাযওয়ায়ে বনী কাইনুকা' পাঁচ. গাযওয়ায়ে সাবিক তিনটি সারিয়া প্রেরণ করেছেন।
এক. সারিয়ায়ে আব্দুল্লাহ ইবনে জাহাশ, দুই সারিয়ায়ে উমাইর, তিন.সারিয়ায়ে সালিম। এ বৎসর গাযওয়ার মধ্যে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হল গাযওয়ায়ে বদর।
৩য় হিজরী
এ হিজরীতে তিনটি গাযওয়া অনুষ্ঠিত হয়েছে।
এক. গাযওয়ায়ে গাতফান, দুই. গাযওয়ায়ে উহুদ, তিন. গাযওয়ায়ে হামরাউল আসাদ।
দুটি সারিয়া অনুষ্ঠিত হয়েছে। এক.সারিয়ায়ে মুহাম্মদ বিন মাসলামা, দুই. সারিয়ায়ে যাইদ ইবনে হারেসা, এ বৎসর যুদ্ধগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল উহুদ যুদ্ধ ।
৪র্থ হিজরী
এ হিজরীতে দুটি গাযওয়া অনুষ্ঠিত হয়েছে। এক. গাযওয়ায়ে বনী নযীর. দুই. গাযওয়ায়ে বদরে সুগরা। চারটি সারিয়া প্রেরণ করা হয়েছে। এক. সারিয়ায়ে আবু সালামা, দুই. সারিয়ায়ে আব্দুল্লাহ ইবনে উনাইস, তিন সারিয়ায়ে মুনযির, চার. সারিয়ায়ে মারসাদ।
৫ম হিজরী
এ হিজরীতে চারটি গাযওয়া অনুষ্ঠিত হয়েছে। যেগুলোতে মহানবী সা. স্বয়ং অংশ গ্রহণ করেছেন। এক. গাযওয়ায়ে যাতুর রিকা, দুই. গাযওয়ায়ে দাওমাতুল জান্দল, তিন. গাযওয়ায়ে মুরাইসী',যেটাকে গাযওয়ায়ে বনী মুসতালিক বলা হয়। চার. গাযওয়ায়ে খন্দক। এগুলোর মধ্যে খন্দক অধিক গুরুত্বপূর্ণ ও প্রসিদ্ধ
৬ষ্ঠ হিজরী
এ হিজরীতে তিনটি গাযওয়া অনুষ্ঠিত হয়েছে।
এক. গাযওয়ায়ে বনী লাহয়ান, দুই গাযওয়ায়ে গাবা, যেটাকে যি কারদও বলা হয় । তিন. গাযওয়ায়ে হুদায়বিয়া ।
এগারটি সারিয়া প্রেরণ করেছেন।
এক. কারতার দিকে সারিয়ায়ে মুহাম্মদ বিন মাসলামা রা. দুই সারিয়য়ে উক্কাশা . তিন. যিল কিস্সার দিকে সারিয়ায়ে মুহাম্মদ বিন মাসলামা রা.
চার. বনী সালিমের দিকে সারিয়ায়ে যাইদ বিন হারেসা রা.। পাঁচ. সারিয়ায়ে আব্দুর রাহমান ইবনে আউফ রা. ছয়.সারিয়ায়ে আলী রা.
সাত, উম্মে কুরফার দিকে সারিয়ায়ে যাইদ বিন হারেসা রা. আট. সারিয়ায়ে আব্দুল্লাহ ইবনে উতাইক রা. নয়, সারিয়ায়ে আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা রা. দশ. সারিয়ায়ে কুরয ইবনে যাবের রা. এগার.সারিয়ায়ে আমর আদদামরী রা.।
এবছর যুদ্ধগুলোর মধ্যে হুদায়বিয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
৭ম হিজরী
এই হিজরীতে শুধু খাইবর যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়েছে। যেটা গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধের একটি। পাঁচটি সারিয়া প্রেরণ করেছেন। এক.সারিয়ায়ে আবু বকর রা. দুই. সারিয়ায়ে বিশর ইবনে সাআদ রা. তিন. সারিয়ায়ে গালেব ইবনে আব্দুল্লাহ, চার.সারিয়ায়ে বাশীর, পাঁচ. সারিয়ায়ে আহযাম রা.।
৮ম হিজরী
এ হিজরীতে চারটি গুরুত্বপূর্ণ গাযওয়া হয়েছে। এক গাযওয়ায়ে মৃতা, দুই. মক্কা মুয়ায্যামা বিজয়,
তিন গাযওয়ায়ে হুনাইন, চার. গাযওয়ায়ে তায়েফ । দশটি সারিয়া প্রেরণ করেছেন। এক.বনী মুলাওয়াহার দিকে সারিয়ায়ে গালেব, দুই. ফাদাকের দিকে সারিয়ায়ে গালেব, তিন. সারিয়ায়ে সুজা, চার, সারিয়ায়ে কাআব রা. পাঁচ, সারিয়ায়ে আমর ইবনুল আস রা. ছয়. সারিয়ায়ে আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহ রা. সাত. সারিয়ায়ে আবু কাতাদা রা. আট. সারিয়ায়ে খালিদ রা. তাকে গুমাইসাও বলা হয়। নয়, সারিয়ায়ে তুফাইল ইবনে আমর দাউসী রা. দশ, সারিয়ায়ে কুতবা রা.
৯ম হিজরী।
এ হিজরীতে শুধু তাবুক যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়েছে। যেটা গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধের একটি। তিনটি সারিয়া প্রেরণ করা হয়েছে। এক. সারিয়ায়ে আলকামা রা. দুই. সারিয়ায়ে আলী রা. তিন. সারিয়ায়ে উক্কাশা রা.
১০ম হিজরী
এই হিজরীতে শুধু দু'টি সারিয়া প্রেরণ করেছেন। এক. নাজরানের দিকে সারিয়ায়ে খালিদ বিন ওলীদ রা. দুই.
ইয়ামনের দিকে সারিয়ায়ে আলী রা. এ বৎসরেই হজ্জাতুল বিদা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
১১তম হিজরী
এই হিজরীতে মহানবী সা. উসামা রা. এর নেতৃত্বে মাত্র একটি সারিয়া পাঠানোর নির্দেশ দেন। তিনি মহানবী সা. এর ইন্তেকালের পর যাত্রা করেন।
সর্বমোট গাযওয়া তেইশটি, সারিয়া তেতাল্লিশটি ।
স্মর্তব্য: মুহাদ্দিস এবং মুসলিম ঐতিহাসিকদের পরিভাষায় গাযওয়া ও সারিয়া শব্দের ব্যবহার এত ভ্যাপক যে, সামান্য সামান্য এবং স্বাভাবিক ঘটনাগুলোকেও গাযওয়া ও সারিয়া বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। যদি দুএকজন কোন অপরাধীকে গ্রেফতারের জন্য গিয়ে থাকেন তো ঐতিহাসিকরা সেটাকেও সারিয়া নামে অভিহিত করেছেন। কয়েক জন লোক সাধারণ কোন গোত্রের সংশোধন বা তাদের অবস্থা জানার জন্য গেছেন সেটাকেও সারিয়া বলা হয়েছে।
এমনিভাবে গাযওয়ার অর্থেও ঐতিহাসিকদের পরিভাষায় ব্যাপক প্রশস্ততা রয়েছে। এই কারণে গাযওয়া ও সারিয়ার মোট সংখ্যা উল্লেখিত বিবরণ অনুযায়ী ৬৬ তে উপনীত হয়েছে। অন্যথায় আমাদের উরফে জিহাদ ও গাযওয়া বলতে যে গুরুত্বপূর্ণ অভিযান মনে করা হয় তা এসব ঘটনার মধ্যে মাত্র কয়েকটি। সেগুলো কিছু বিস্তারিত আলোচনা সাথে পাঠক মহলে পেশ করা হচ্ছে।