জুলুম আর অত্যাচারের সূচনা - The beginning of oppression and tyranny
06:22:22 12/11/2023
যুলুম আর অত্যাচারের সূচনা : রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাওয়াতের কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন। কুরাইশরা তাঁর থেকে ও তাঁর চাচা আবু তালিব থেকে নিরাশ হয়ে গেল। তাদের ক্রোধের মাত্রা ছাড়িয়ে গেল। তাই এবার তারা এক নতুন পথ অবলম্বন করল। প্রত্যেক কবীলা তাদের মধ্য থেকে যারা মুসলমান হয়েছিল তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তাদেরকে বন্দী করে রাখল। ক্ষুধা, তৃষ্ণা এবং শারীরিক নির্যাতন চালাতে লাগল তাদের ওপর। কাউকে দুপুর বেলায় রৌদ্রতপ্ত মরুভূতে নিয়ে আগুন-বালুর ওপর শুইয়ে রাখা হতো।
বিলাল রা. ইসলাম গ্রহণ করলে তার মনিব উমাইয়্যা বিন খলফ দুপুর হলে মরুভূর বালুরাশি যখন খৈ ফোটা রূপ ধারণ করত, তখন উমাইয়্যা বিলাল রা. কে সেই বালুর ওপর চিত করে শুইয়ে রাখত। এরপর তার বুকের ওপর বিশাল এক পাথরখণ্ড রেখে দিত। অতঃপর সে তাকে বলত, আল্লাহর কসম! যতক্ষণ না তুমি মৃত্যুবরণ করবে কিংবা মুহাম্মাদকে অস্বীকার করে লাত ও উয্য়ার ইবাদত করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তোমাকে এভাবেই রেখে দেওয়া হবে। তখন তিনি সেই মুসীবতের মাঝেও বলতেন, "আহাদ', 'আহাদ' তথা আল্লাহ এক, আল্লাহ এক।
একদিন আবু বকর রা. তার পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। তখন তিনি উমাইয়্যাকে বিলালের চেয়েও শক্তিশালী একটি কালো গোলাম দান করেন। এবং বিলালকে উমাইয়্যার কাছ থেকে নিয়ে আযাদ করে দেন।
একইভাবে বনু মাখযূমের লোকেরা তাদের স্বগোত্রীয় ইসলামী পরিবারের সদস্য আম্মার বিন ইয়াসির রা. ও তাঁর পিতা-মাতাকে ধরে তুখর রৌদ্রতপ্ত দুপুরে মরুভূমিতে নিয়ে যেত। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের পাশ দিয়ে গমন করলেন। তখন তিনি তাদেরকে এই অবস্থায় দেখে বলেছিলেন- সবর করো হে ইয়াসিরের পরিবার! তোমাদের জন্য জান্নাতের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। পরবর্তীর্তে তার মাতাকে হত্যা করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারপরেও তিনি ইসলাম ছাড়েননি।
সাহাবী মুসআব বিন উমাইর রা. ছিলেন একজন শক্তিশালী ও সামর্থ্যবান টগবগে যুবক। দৈহিক সৌন্দর্যেও তিনি ছিলেন অতুলনীয়। তিনি ছিলেন পিতা- মাতার একান্ত আদরের সন্তান। তার মাতা ছিলেন অনেক ধনাঢ্য মহিলা। বাজারের ভালো কাপড়টি এনে তিনি তার ছেলে মুসআবকে পরাতেন। গোটা মক্কার সবার মধ্যে তিনি তার জামা-কাপড়ে উত্তম সুগন্ধি ব্যবহার করতেন এবং তিনি পরতেন হাযরামাউত থেকে আমাদানীকৃত জুতো। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার ব্যাপারে বলতেন, আমি গোটা মক্কায় শারীরিক সৌন্দর্য, পোশাক-আশাকের বাহার আর অধিক আদর-সোহাগে লালিত পালিত হতে মুসআব বিন উমাইরের চেয়ে আর কাউকে দেখিনি ।
মুসআব বিন উমাইর একদিন খবর পেলেন যে, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানুষকে ইসলামের দিকে আহ্বান করছেন। তখন তিনি দারুল আরকামে চলে গেলেন। ভেতরে প্রবেশ করে তিনি মুসলমান হলেন। নবীজীকে সত্যায়ন করলেন। অতঃপর বের হয়ে তার মাতা ও কওমের ভয়ে তিনি ইসলামকে লুকিয়ে রাখলেন। কিন্তু গোপনে গোপনে বারবার তিনি রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে যেতেন। একদিন উসমান বিন তালহা তাকে নামায পড়তে দেখে তার মা ও তার কওমকে জানিয়ে দিলো। তারা তাকে গ্রেফতার করে বন্দী করে রাখল। হাবশার দিকে প্রথম হিজরতের আগ পর্যন্ত দীর্ঘদিন তিনি বন্দী অবস্থাতেই ছিলেন। অতঃপর হাবশার দিকে হিজরত করলেন। কিছুদিন পরে আবার মক্কায় ফিরে এলেন। কিন্তু মক্কায় যখন তিনি ফিরে এলেন ততদিনে এমন সরল আর স্বাভাবিক জীবন যাপন আর চাল- চলনে তিনি ফিরে গিয়েছিলেন যে, তার মা তাকে দেখে আর নিন্দা করতে পারেননি।
আবার কোনো কোনো মুসলমান সম্ভ্রান্ত মুশরিকদের তত্ত্বাবধানে ছিলেন। তারাই তাদেরকে হিফাযত করতেন। উসমান বিন মাযউন ছিলেন ওলীদ বিন মুগীরার তত্ত্বাবধানে। কিন্তু পরবর্তীতে উসমানের আত্মমর্যাদাবোধে আঘাত লাগলে নিজেকে ওলীদের নিরাপত্তার গণ্ডি থেকে বের করে নিয়েছিলেন। এবং বলেছিলেন- আল্লাহ তাআলা ব্যতীত আর কারও নিরাপত্তার মধ্যে আমি থাকব না। একদিন কথায় কথায় এক মুশরিক আর তার মাঝে ঝগড়া লেগে যায়। মুশরিক লোকটি তখন তাকে এমন জোরে চড় মারে, যাতে তার একটি চোখ নষ্ট হয়ে যায়। তখন ওলীদ বিন মুগীরা পাশেই বসা ছিল।
সে বলল, ভাতিজা! আল্লাহর কসম- তোমার চোখ তো এই বিপদের অনেক ঊর্ধ্বে ছিল। তুমি তো ছিলে সুরক্ষিত নিরাপত্তার গণ্ডিতে। তখন উসমান বিন মাযউন রা. বললেন, আল্লাহর কসম! আমার ভালো চোখটিরও সেই চোখটির মতো হওয়া উচিত- যেই চোখটি আল্লাহর রাস্তায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছে। মনে রেখো আবদে শামস- আজ আমি এমন এক সত্তার তত্ত্বাবধানে রয়েছি যিনি তোমার চেয়ে অনেক বেশি ইয্যতওয়ালা এবং অধিক শক্তিশালী ।
উসমান বিন আফ্ফান রা. ইসলাম গ্রহণ করলে তার চাচা হাকাম বিন আবুল আস বিন উমাইয়্যা তাকে শক্ত করে বেঁধে বলল, বাপ-দাদার ধর্ম বাদ দিয়ে এক নতুন ধর্ম তোমার কী করে ভালো লাগল? আল্লাহর কসম! এই দীন ছেড়ে দেওয়ার আগ পর্যন্ত তোমার এই বাধন আমি খুলব না। তখন উসমান রা. বললেন, আল্লাহর কসম! সেই ধর্ম আমি কোনোদিনও ছাড়ব না। যখন হাকাম দেখল উসমানের পাহাড়সম দৃঢ়তাকে টলানো সম্ভব হবে না, তখন সে তাকে ছেড়ে দিলো ।
খাব্বাব বিন আরত রা. বলেন, একদিন তারা আমাকে ধরে আগুনের ওপর নিক্ষেপ করল। অতঃপর এক ব্যক্তি আমার বুকের ওপর পা রেখে সেই আগুনের ওপর চেপে ধরল। যখন আমার পিঠের ঘাম কিংবা রক্তে সেই আগুন নিভে যেত-কিংবা যমীন ঠাণ্ডা হয়ে যেত- তখন তারা আমাকে ছেড়ে দিত। কিন্তু ততক্ষণে আমার পিঠে আগুনে পোড়া বিকৃত সাদা দাগ পড়ে গিয়েছিল।