ইবরাহীম (আঃ) এর বংশ তালিকা - The genealogy of Ibrahim (as).
05:48:52 12/04/2023
ইবরাহীম (আঃ) এর বংশ তালিকা : তাওরাতে হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর বংশ তালিকা বর্ণিত হয়েছে নিম্নরূপ : ইবরাহীম (খলীলুল্লাহ) বিন তারিখ বিন নাহর বিন সারজ বিন রাউ বিন্ ফালিহ বিন 'আবির বিন শালিহ বিন আরফিকশায় বিন সাম বিন নূহ (আ)।
উপরোক্ত বর্ণনা তাওরাত ও প্রাচীন ইতিহাস কর্তৃক সমর্থিত। তবে পবিত্র কুরআনে তাঁর পিতার নাম 'আযর' বলে বর্ণনা করা হয়েছে। "স্মরণ কর, ইবরাহীম তার পিতা আযরকে বলেছিল, 'আপনি কি মূর্তিকে উপাসা রূপে গ্রহণ করেন?" (সূরা আন'আম : আয়াত : ৭৪)
আযর সম্পর্কে পর্যালোচনা
ইতিহাসে এবং তাওরাতে ইবরাহীম (আ)-এর পিতার নাম 'তারিখ' বলা হয়েছে, অপরদিকে কুরআনে বলা হয়েছে 'আযর'। তাই উলামা ও মুফাসিরীন এ বিষয়টির পর্যালোচনায় দুটি পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন। যেমন :
(১) এমন ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে যাতে দুটি নামের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করা যায় এবং মতপার্থক্যের কোন সুযোগ না থাকে।
(২) আলোচনা পর্যালোচনার পর সিদ্ধান্ত নিতে হবে, এ দুটির মধ্যে কোনটিকে ঠিক এবং কোনটি অধিকতর সঠিক অথবা দুটিই ঠিক তবে তা ভিন্ন ভিন্ন দুই ব্যক্তির নাম।
প্রথম মতামত পোষণকারী আলিমগণ বলেন, এ দুটি নাম একই ব্যক্তির। 'তারিখ' হচ্ছে তার মূল নাম, আর আমর হচ্ছে গুণবাচক নাম।
এদের কারো কারো মতে, ইবরানী ভাষায় আযর অর্থ মূর্তি প্রেমিক। যেহেতু 'তারিখ' এর মধ্যে মূর্তি নির্মাণ এবং মূর্তি পূজা উভয় গুণই ছিল তাই সে আযর' নামে খ্যাতি অর্জন করে। (১) ইবনে কাসীর : প্রথম খন্ড : পৃষ্ঠা-৬৭।
(২) ইবনে কাসীর : প্রথম খণ্ড : পৃষ্ঠা-৬৭।
আবার কারো কারো মতে, আযর অর্থ বুদ্ধিহীন, আহমক, অথবা বুড়ো ইত্যাদি। যেহেতু “তারিখ” এর মধ্যে এসব গুণাবলি বিদ্যমান ছিল তাই সে আযর নামে পরিচিত। পবিত্র কুরআনও এইগুণবাচক নামে তার উল্লেখ করেছে। সুহায়লী তার 'রওযুল উফ' গ্রন্থে এই মতই গ্রহণ করেছেন।
দ্বিতীয় মতামত পোষণকারী উলামায়ে কিরামের মতে, আযর সে দেবতার (মূর্তির) নাম 'তারিখ' ছিল যার পূজারী বা মঠাধ্যক্ষ। কেননা হযরত মুজাহিদ (রঃ) থেকে বর্ণিত রয়েছে কুরআনের আয়াত- অর্থ হচ্ছে (তুমি কি আযর অর্থাৎ মূর্তিকে উপাস্য মান?)
“সাগানী'র মতামতও প্রায় অনুরূপ। তবে বৈয়াকরণিক দিক দিয়ে তাৎপর্য বিশ্লেষণে তিনি কিছুটা ভিন্নপথ অবলম্বন করেছেন। যা হোক এ উভয়ের মতে 'আর' (তার পিতা)-এর বা বিশ্লেষণকারী নয় বরং তা মূর্তিরই নাম। অতএব বলা যায়, পবিত্র কুরআনে তাঁর পিতার নাম বর্ণনা করা হয়নি।
একটি বিখ্যাত মতামত এ হযরত ইবরাহীমের পিতার নাম ছিল তারিখ, ৩ আর চাচার নাম ছিল আযর। যেহেতু আযরই তাকে লালন-পালন করেছিল। তাই (পালক পিতা হিসাবে) পবিত্র কুরআনে তাকে (ইবরাহীম-এর) পিতা।
(১) তাজুল উরূস ও তৃতীয় খন্ড ঃ পৃষ্ঠা-১২।
(২) রওযুল উফ : প্রথম খন্ড ।
(৩) তাজুল উরুস ঃ তৃতীয় খণ্ড : পৃষ্ঠা-১২।
(৪) কাসাসুল আম্বিয়া : পৃষ্ঠা-৯৬।
বলা হয়েছে যেমন নবী (স) বলেছেন, অর্থাৎ চাচা পিতারই স্বদৃশ। আল্লামা আবদুল ওহহাব নাজ্জার বলেন, বর্ণিতত মতসমূহের মধ্যে ইমাম মুজাহিদের মতই অধিক বিবেকশ্বত ও গ্রহণযোগ্য । কেননা প্রাচীন মিসরবাসীদের একটি দেবতার নাম ছিল আরিস যার অর্থ খোদার সহায়তাকারী। আর পৌত্তলিক জাতিসমূহের মধ্যে আদিকাল থেকেই এ পদ্ধতি চলে আসছে তারা পুরাতন দেবতাদের নামের অনুকরণে নতুন দেবতাদের নামকরণ করে থাকে। অতএব পুরাতন দেবতা 'আয়ূরিস'-এর নামানুকরণে ঐ নতুন দেবতার নাম 'আযর' রাখা হয়েছিল। অন্যথায় হযরত ইবরাহীম (আ)-এর পিতার নাম ছিল 'তারিখ'।
আমাদের মতে, এসব লম্বা-চওড়া ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে মাথা ঘামানো নিষ্প্রয়োজনীয় কর্ম তথা পন্ডশ্রম ছাড়া কিছু নয়। কেননা পবিত্র কুরআন যখন স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছে ইবরাহীমের পিতার নাম ছিল আযর, যখন শুধু বংশ লতিকাবিদ ও বাইবেলের অনুমানভিত্তিক তথ্যাদির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পবিত্র কুরআনের প্রকৃত বিশ্লেষণকে রূপকে বিশ্লেষণ আখ্যা দেয়া কিংবা আরো সামনে বেড়ে পবিত্র কুরআনের শব্দের মধ্যে বৈয়াকরণিক মারপ্যাঁচ সৃষ্টির কোন প্রয়োজন নেই থাকতে পারে না।
যদি স্বীকার করেও নেয়া হয় আযর অর্থ মূর্তি প্রেমিক বা খোদ মূর্তির নাম, তদরূপ অতি ব্যাখ্যা ও রূপকতার দিকে না দিয়ে অনায়াসে বলা যেতে পারে উপরোক্ত দুটি কারণেই আযরের নাম "আযর' রাখা হয়েছিল । কেননা পৌতলিক জাতিসমূহের মধ্যে প্রাচীনকাল থেকে এই নি চলে আসছে তারা কখনো তাদের সন্তান-সন্ততির নাম 'মূর্তির দাস' এই অর্থ জ্ঞানার্থে আবা কখনো খোদ মূর্তির নামেই রাখত ।
মূলকথা হলো, কালনী ভাষায় 'আদার' অর্থ বড় পূজারী আর আরবী ভাষায় 'আর' শ ‘আদ-দার' এরই অপভ্রংশ। 'তারিখ' যেহেতু মূর্তি নির্মাতা এবং সবচেয়ে বড় পুজারী (মঠাধ্যক্ষ) ছিল তাই সে 'আযর' নামে খ্যাতি অর্জন করে। প্রকৃতপক্ষে এটা তার নাম নয় বরং উপাধি। আর উপাধি খ্যাতির দিক দিয়ে নামের উপর চলে যাওয়ায় কুরআন তাকে সে নামে (উপাধি-নাম) সম্বোধন করেছে।
তাছাড়া যে মহান ব্যক্তির (ইবরাহীমের) চারিত্রিক মাহাত্ম্য এত উপরে ছিল মূর্তি পূজার বিরোধিতা করতে গিয়ে আযবের সাথে যখন তার বাকবিতণ্ডার সৃষ্টি হয় এবং আয়র ক্ষিপ্ত হয়ে যখন বলে উঠে- 'হে ইবরাহীম, তুমি কি আমার দেব-দেবী থেকে বিমুখ হচ্ছো? যদি তুমি নিবৃত্ত না হও তবে আমি প্রস্তরাঘাতে তোমার প্রাণনাশ করবোই; তুমি চিরদিনের জন্য আমার কাছ থেকে দূর হয়ে যাও। (সূরা মরিয়াম আয়াত : ৪৬) তখনও যিনি পিতৃত্ব সম্বন্দের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে উত্তর দেন- "তোমার কাছ থেকে বিদায়। আমি আমার প্রভুর নিকট তোমার জন্য ক্ষমা ফরিয়াদ করবো, তিনি আমার প্রতি অতিশয় অনুগ্রহশীল। (সূরা মরিয়াম আয়াত : ৪৭) - সে ব্যক্তির পক্ষে এটা কি করে সম্ভব হতে পারে তিনি স্বীয় পিতা 'আমরকে আহমক, অথবা বুড়ো প্রভৃতি অপমানসূচক শব্দদ্বারা সম্বোধন করবেন।
অতএব ইতিহাসের 'তারিখ' নিসন্দেহে আযরই ছিলেন। আযর তার গুণবাচক নাম নয় বরং মূল নাম। আর তারিখ হল তার ভ্রান্ত নাম, নয়তো 'আযর' শব্দের অনুবাদ, যা তাওরাতের অপরাপর নামের মত অনুবাদের স্কুলে মূল হয়ে গেছে।
মারাতিশী হচ্ছেন সপ্তদশ শতাব্দীর একজন খৃষ্টান পন্ডিত। তিনি কুরআনের অনুবাদ করেছেন এবং তাতে দুশমনীমূলক ও পক্ষপাতদৃষ্ট বিভিন্নমুখী সূক্ষ্ম আক্রমণ চালিয়েছেন। তিনি তখনো তার অভ্যাস অনুযায়ী একটি অর্থহীন ও বাজে প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন, যার মমার্থ হলো, ‘ইউবিউস' লিখিত ইতিহাসের একটি বাক্যে এই শব্দ এসেছে যাকে ভ্রান্তরূপে মুহাম্মদ (সঃ) কুরআনের অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, মারাতিশী এই দাবির পক্ষে না উল্লেখিত ইতিহাসের ঐ বাক্য উদ্ধৃত করেছেন যা থেকে এ শব্দ নেয়া হয়েছে, আর না সে মূল শব্দের কোন সন্ধান দিয়েছেন যাতে ভ্রান্তরূপে কুরআনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মুহাম্মদ (সঃ)-এর এমনকি প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল যার কারণে তিনি একটি শব্দকে তার ভ্রান্তরূপে উদ্ধৃত করতে বাধ্য হলেন, মারাতিশী তারও কোন ব্যাখ্যা দেননি। অতএব তার ঐ কথাটি দুশমনীতামূলক, ভিত্তিহীন ও পক্ষপাতদুষ্ট। এক্ষেত্রে মূল কথা তাই যা আমরা উপরে উল্লেখ করেছি।