ইবরাহিম আ. এর মুর্তি ভাঙ্গার ঘটনা - The incident of breaking the statue
05:43:35 12/04/2023
ইবরাহিম আ. এর মুর্তি ভাঙ্গার ঘটনা : হযরত ইব্রাহীম (আ) মনে মনে চিন্তা করতে ছিলেন যে, এমন একটি কাজ করে সকলকে দেখানো দরকার যাতে তারা নিশ্চিতরূপে বুঝতে পারে যে, এসব মূর্তিকে পূজা করার কোন উপকার নেই। যেহেতু এদের ভাল-মন্দ কোন কিছু করারই কোন প্রকার ক্ষমতা নেই। এরা একেবারেই অক্ষম-অথর্ব। অতএব এদের পূজা করা শুধু মূর্খতা এবং বোকামীর প্রমাণ।
নমরূদের রাজধানী নগরীতে বিরাট একটা দেবমন্দির ছিল। ঐ মন্দিরে অসংখ্য দেব-দেবীর মূর্তি ছিল । নগরীর সকল মূর্তিপূজকেরা সেখানে গিয়ে তার পূজা-অর্চনা করত। একদিন বিশেষ এক পর্ব উপলক্ষে দেশের সকলেই একটি মেলায় চলে গেল। হযরত ইব্রাহীম (আ)-এর পিতাও সেখানে যাবারকালে ছেলে ইব্রাহীম (আ)-কেও নিয়ে যেতে চাইল, কিন্তু তিনি শারীরিক অসুস্থতার ওজর দেখিয়ে থেকে গেলেন, মেলায় গেলেন না। ঐদিন নগরীর প্রধান মন্দিরে কোন পুরোহিত ছিল না।
তারাও মন্দির খালি রেখে মেলার উৎসবে যোগদান করল, সুতরাং মন্দির একেবারে লোকশূন্য অবস্থায় পড়ে রইল। এমতাবস্থায় হযরত ইব্রাহীম (আ) একখানা কুঠার নিয়ে খালি মন্দিরে প্রবেশ করলেন এবং দেখতে পেলেন যে, মূর্তিগুলোর পায়ের কাছে বহু রকমের সুস্বাদু ও উপাদেয় খানা এবং মূল্যবান বস্ত্রাদি সাজানো রয়েছে। মূর্তিপূজকগণ তা এ উদ্দেশ্যে রেখে গেছে যে, তাদের পূজা দেবতাদের আশীর্বাদে ঐগুলো পুন্যময় হবে। তারপর তা ভক্ষণ এবং পরিধান করলে তাতে তাদের বহু কল্যাণ এবং মঙ্গল সাধিত হবে।
হযরত ইব্রাহীম (আ) মূর্তিগুলোকে সম্বোধন করে বললেন, কি হে, তোমরা না জাগ্রত দেবতা সকল, তবে এসব উপাদেয় খাবার সামগ্রীগুলো এভাবে পায়ের নিকট পড়ে আছে, তা খাচ্ছে না কেন?
একটু অপেক্ষা করে তিনি আবার বললেন, কি হে, তোমরা যে আমার কথার জবাবও দিতেছ না বা এতটুকু নড়া-চড়াও করছ না। তবে তোমরা কি একেবারেই জড়-নির্জীব আর যদি তাই হয়, তবে অযথা তোমাদের পায়ে সম্মান করে মূর্খ লোকগুলো কি ফায়দা লাভ করে। দেখছি সবই মিথ্যা, সবই অহেতুক। অতএব আজ আমি এ মিথ্যা মূর্তিগুলোর দফা রফা করে দেয়ার জন্য এখানে এসেছি। এ বলে তিনি হাতে ধরা কুঠারের আঘাতে এক এক করে মূর্তিগুলোকে ভেঙ্গে চুরমার করলেন। শুধুমাত্র সর্ববড় মূর্তিটিকে অক্ষত রেখে তার গলায় কুঠারখানা ঝুলিয়ে নিয়ে মন্দির হতে নিজে বের হয়ে আসলেন।
মূর্তিপূজক মুশরেকগণ মেলা হতে ফিরে এসে মন্দিরে প্রবেশ করে দৃশ্য দেখে বিশ্বয়ে বিমূঢ় হয়ে গেল। তারা তাদের দেবতাদেরকে এ চরম দুর্দশা অবলোকন করে শুধু হায় হায় করতে লাগল আর চীৎকার করে বলতে লাগল, হায় কোন দুর্বৃত্ত আমাদের দেবতাদের সাথে এমন দুর্ব্যবহার করলঃ কে এমন মহাপাপের কাজ করতে সাহস পেল। তারা পরস্পরে বলা-কওয়া করতে লাগল, আমাদের দেশে এমন তো কোন লোক আছে বলে মনে হয় না যে, আমাদের দেবতাদের মূর্তির সাথে এমন বে-আদবী করতে পারে, কিন্তু কতিপয় ব্যক্তি এর প্রতিবাদ করে বলল, তোমরা কি বলছ, তবে এ কোন বিদেশাগত লোকের কাজ না কি? কে এ কাজ করেছে, আমরা তা ভাল করেই জানি। এ আজর-পুত্র ইব্রাহীম ছাড়া আর কেউ করেনি, তার দ্বারাই একাজ সাধিত হয়েছে। সে একদিন আমাদের মূর্তিসমূহের সাথে এরূপ দুর্ব্যবহার করবে বলে একাকী শপথ করেছিল, তা আমাদের কানে এসেছ, সুতরাং এ যে শুধু তারই কাজ তাতে কোন সন্দেহ নেই।
এ ঘটনার বিষয়টি পবিত্র কোরআনের ভাষায় বর্ণিত হয়েছে নিম্নোক্তভাবে যথাঃ তারা (সকলে অথবা প্রথমা জিজ্ঞেসকারীগণ) বলল, (যনি একথাই হয়) আচ্ছা তবে তাকে সকল লোকদের সামনে উপস্থিত কর, তা হলে (সম্ভবতঃ) সে স্বীকার করে ফেলবে এবং তারা (তার অঙ্গীকারের) সাক্ষী হয়ে যাবে। (তারপর) তারা (তাকে) বলল, তুমি কি আমাদের দেবতাগণের সাথে এ কাজ করেছ হে ইব্রাহীম (আ)। তিনি (উত্তরে) বললেনঃ না, বরং তাদের এ প্রধান শুরু করেছে। অতএব তাদেরই নিকট জিজ্ঞেস করে দেখ না। যদি তাদের কথা বলার ক্ষমতা থাকে। এতে নিজেরা মনে মনে চিন্তা করল, তারপর (একে অন্যকে) বলল, প্রকৃত পক্ষে তোমরাই অন্যায় পথে রয়েছ। (অনন্তর লজ্জায় তারা মাথা হেট করল (এবং বলল) হে ইব্রাহীম, তুমি তো অবগত আছ যে, এ মূর্তিসমূহ (কোন) কথা বলতে পারে না।
এরপর তারা হযরত ইব্রাহীম (আ)-কে ধরে তাদের বাদশাহ নমরূদের দরবারে নিয়ে গেল । নমরূদ হযরত ইব্রাহীম (আ)-কে জিজ্ঞেস করল, মন্দিরের মূর্তিগুলোকে কে ভেঙ্গেছে? তিনি উত্তর করলেন, তোমাদের বড় মূর্তিটার ঘাড়ে কুঠার ঝুলানো দেখলাম। সম্ভবতঃ সে. ভেঙ্গেছে। এতে নমরূদ অত্যন্ত রাগান্বিত হয়ে বলল, সে কি চলাফেরা করতে পারে বা হাত-পা নাড়াইবার ক্ষমতা রাখে যে, দেব-মূর্তিগুলোকে ভেঙ্গে ফেলবে? হযরত ইব্রাহীম (আ) বললেন, যদি তাই হয় তবে তোমরা বে-আকলের মত তাদের পূজা কর কোন দুঃখে?
হযরত ইবরাহীম-এর উচ্চ মর্তবা
নবী-রসূলদের মধ্যে হযরত ইবরাহীমের যে উচ্চ মর্তবা রয়েছে তারই প্রেক্ষিতে কুরআন তাঁর ঘটনাবলিকে বিভিন্ন ভঙ্গিতে বর্ণনা করেছে। এক স্থানে সংক্ষেপে বর্ণনা করেছে, তো অপর স্থানে বিস্তৃত আকারে। তাছাড়া বিভিন্ন স্থানে তাঁর ব্যক্তিত্বকে তুলে ধরা হয়েছে বিভিন্ন গুণাবলির সাথে। তার এই অবস্থার প্রেক্ষিতে আমরা নিচে তাঁর জীবনের ঘটনাবলিকে একটি নির্দিষ্ট ক্রমানুসারে উপস্থাপনের প্রয়াস পাচ্ছি।
তাওরাতের বর্ণনা অনুযায়ী ইবরাহীম (আ) ছিলেন আওর পল্লীর অধিবাসী এবং আহলে ফিদদীনের অন্যতম। তাঁর কওম ছিল পৌত্তলিক। বার্নাবার ইঞ্জিলে স্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে তাঁর পিতা ছিলেন ছুতার এবং কাঠের মূর্তি তৈরি করে তা তার কওমের বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে বিক্রি করতেন।
কিন্তু আল্লাহ তাআলা হযরত ইবরাহীম (আ)-কে শিশু বয়সেই অত্যন্ত দূরদর্শিতা প্রদান করেন। তিনি তখনই বিশ্বাস করতেন মূর্তিরা যেমন কিছু শুনতে পারেনা তেমনি কিছু দেখতেও পারে না। না তারা কারো আবেদনে সাড়া দিতে পারে, আর না কারো উপকার বা অপকার করতে পারে। কাঠের তৈরি খেলনা ও অপরাপর আসবাবপত্র এবং এদের মধ্যে কোনই পার্থক্য নেই। তিনি রাতদিন দেখতেন, তাঁর পিতা নিজের হাতে বিভিন্ন ধরনের মূর্তি তৈরি করেছেন, যন্ত্র চালিয়ে তাদের মধ্যে নাক-কান, চোখ-মুখ ইত্যাদির সৃষ্টি করছেন, অতপর তা ক্রেতাদের মধ্যে বিলিয়ে দিচ্ছেন। তিনি দেখতেন আর অবাক হয়ে ভাবতেন, এরা কি করে খোদা বা খোদার সমতুল্য হতে পারে?