নামাজে আমিন বলার নিয়ম - The rule of saying Amen in prayer
00:36:14 12/04/2023
নামাজে আমীন বলার নিয়ম : সূরা ফাতিহা নামাজের মৌলিক বিষয়বস্তুর মধ্যে অন্যতম- যা আল্লাহর মাহাত্ম্যের বর্ণনা, দাসত্বের স্বীকারোক্তি ও মোনাজাত সম্বলিত । তাই সূরা ফাতিহার মাধ্যমে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা শেষে 'আমীন' বলা, যা অত্যন্ত তাৎপর্য ও ফযিলতপূর্ণ । হাদীস শরীফে ইরশাদ হচ্ছে- ইমাম যখন غير المغضوب عليهم ولا الضالين
বলেন, তখন তোমরা 'আমীন' বল। কেননা, যার আমীন বলা ফিরিশতার আমীন বলার সাথে মিলবে তার পূর্ববর্তী সব গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।
আর এই ফজিলতের সাথে আমীন উচ্চস্বরে বলা বা অনুচ্চস্বরে বলার কোন | সম্পর্ক নেই। এ ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে কোন কওলী হাদীস নেই । কয়েকটি রেওয়ায়েতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আমল বর্ণিত হয়েছে। এর মধ্যে কোন রেওয়ায়েতে আছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমীন উচ্চস্বরে বলেছেন, আবার কোন রেওয়ায়েতে আছে অনুচ্চস্বরে বলেছেন । প্রত্যেক বর্ণনাকারী তার ইলম অনুযায়ী বর্ণনা করেছেন।
এখন বিষয় হল, 'আমীন' যেহেতু দুআ যার অর্থ 'আপনি আমাদের প্রার্থনা কবুল করুন ।' বিশিষ্ট তাবেয়ী আতা ইবনে আবী রাবাহ রহ. বলেন, আমীন হল দোয়া । আর দুআর নিয়ম হল তা অনুচ্চস্বরে হওয়া। কুরআনুল কারীমে ইরশাদ হচ্ছে,
ادعوا ربكم تضرعا وخفية
অর্থ: তোমরা তোমাদের রবের কাছে চুপিসারে কাকুতি-মিনতি করে দোয়া কর।' এক সফরে সাহাবাগণ উচ্চ আওয়াজে তাকবীর বলছিলেন, তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
اربعوا على أنفسكم فإنكم لا تدعون أصم ولا غائبا ولكن تدعون سميعا
بصيرا قريبا
অর্থ: তোমরা তোমাদের আত্মার উপর করুণা কর (অর্থাৎ উচ্চস্বরে তাকবীর বল না) । কেননা, তোমরা কোন বধির, দূরবর্তী সত্ত্বাকে ডাকছ না, বরং তোমরা এমন সত্ত্বাকে ডাকছ যিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা এবং তোমাদের অতি নিকটে । (বোখারী)
এছাড়াও বেশ কিছু হাদীসে অনুচ্চস্বরে বলার কথা বর্ণিত রয়েছে ।
আমরা আগেই বলেছি, আমীনের ফযিলত সম্পর্কিত হাদীসের সাথে আমীন উচ্চস্বরে বলা বা অনুচ্চস্বরে বালার কোন সম্পর্ক নেই । যেভাবেই আমীন বালা হোক উক্ত ফযিলত লাভ করা যাবে। তাই নামাজের মধ্যে এই আমীন কি উচ্চ আওয়াজে বলবে নাকি অনুচ্চ আওয়াজে বলবে- এ নিয়ে উম্মতের মাঝে সাড়ে বারশত বছর পর্যন্ত কোন বাড়াবাড়ি ছিল না। কেউ বলেছেন, উচ্চ আওয়াজে আমীন বলা উত্তম । যেমন ইমাম শাফেয়ী রহ. ও ইমাম আহমাদ রহ.। আর কেউ কেউ বলেছেন, অনুচ্চস্বরে আমীন বলাটাই উত্তম। যেমন ইমামে আজম আবু হানীফা রহ. ও ইমাম মালেক রহ.।
তবে তারা সকলেই এ ব্যাপারে একমত ছিলেন যে, যেভাবেই আমীন বলুক না কেন নামাজ হয়ে যাবে। কিন্তু হুজুর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের সাড়ে বারশত বছর পর ভারতবর্ষে লা-মাযহাবীরা নামাজে ইমাম ও মুক্তাদী সকলের জন্য আমীন উচ্চস্বরে বলা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা বলে ঘোষণা দেয় । তারা বলে, যদি কেউ অনুচ্চস্বরে আমীন বলে তাহলে তার নামাজ হবে না । অথচ আমীন এর মাসআলায় চার ইমামের মাঝে মতভেদ শুধু এতোটুকু যে, কেউ বলেন, অনুচ্চস্বরে আমীন বলা উত্তম ।
কেউ বলেন, উচ্চস্বরে আমীন বলা উত্তম । তবে যেভাবেই বলুক নামাজ হয়ে যাবে । এ ব্যাপারে সকলে একমত । আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিাম রহ. ও এ ব্যাপারে একমত। তিনি বলেন, অর্থাৎ আমীন উচ্চস্বরে বলা বা অনুচ্চস্বরে বলা এটা একটি বৈধ বিষয়ের ইখতেলাফ (অর্থাৎ উভয়টিই বৈধ। এর কোন একটির উপর আমল করার কারণে বা কোন একটির আমল পরিত্যাগ করার কারণে কাউকে তিরস্কার করা অনুচিত।
আমীন উচ্চস্বরে বলা বা অনুচ্চস্বরে বলার ব্যাপারে যেহেতু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোন কওলী হাদীস নেই, তাই বেশ কিছু আয়াত, হাদীস ও সাহাবা তাবেয়ীগণের আমলের প্রতি লক্ষ্য করে ইমাম আবু হানীফা ও ইমাম মালিক রহ. সহ উম্মতের একটি বড় জামাত 'আমীন' অনুচ্চস্বরে বলাকে উত্তম বলেছেন ।
কুরআনের আলোকে আমীন অনুচ্চস্বরে বলার দলীল
'আমীন' একটি দোয়ার শব্দ। এর দ্বারা আল্লাহ তাআলার দরবারে ফরিয়াদ করা হয় । এর অর্থ হল, اللهم اسجب دعائنا আর্থাৎ হে আল্লাহ! আপনি আমাদের দোয়া কবুল করুন ।
মহান আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমে হযরত মুসা আ. ও হারুন আ. এর দোয়া সম্পর্কে ইরশাদ করেন, قد اجيب دعوتكم (অর্থ : তোমাদের উভয়ের দোয়াকে কবুল করা হল) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় الدر المنثور গ্রন্থে হযরত আবু হুরায়রা রা., ইবনে আব্বাস রা., ইকরিমা রহ., আবু সালেহ রহ. আবুল আলিয়া রহ, প্রমুখ থেকে বর্ণিত আছে যে, দোয়া করেছিলেন হযরত মুছা আ. আর হারুন আ. শুধু আমিন আমিন বলেছিলেন । তা সত্ত্বেও আল্লাহ তাআলা এই আয়াতের মাঝে মূসা আ. ও হারুন আ. উভয়ের কাজকে দোয়া হিসেবে সাব্যস্ত করে বলেছেন যে, তোমাদের উভয়ের দোয়া কবুল করা হল । এর দ্বারা বোঝা যায়, হারুন আ. এর আমীন বলাটাও দোয়া ছিল।
বোখারী শরীফের ১০৭নং পৃষ্টায় বর্ণিত আছে যে, قال عطاء امين دعاء অর্থাৎ আতা রহ. বলেন, আমীন হল দোয়া। আর দোয়া ও জিকিরের এর ক্ষেত্রে সর্বোত্তম পদ্ধতি হল অনুচ্চস্বরে বলা কুরআনুল কারীমে ইরশাদ হচ্ছে,
ادعوا ربكم تضرعا وخفية إنه لا يحب المعتدين
অর্থাৎ তোমরা তোমাদের রবের কাছে চুপিসারে ও কাকুতি-মিনতি করে দোয়া কর । নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা সীমালঙ্ঘনকারীদের ভালোবাসেনা না ।
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় যায়েদ ইবনে আসলাম রহ. বলেন, সীমালঙ্ঘন দ্বারা উদ্দেশ্য হল উচ্চ আওয়াজে দোয়া করা । আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সূরায়ে মারইয়ামের শুরুতে জাকারিয়া আ. সম্পর্কে ইরশাদ করেন-
إذ نادى ربه نداء خفيا
অর্থাৎ আপনি মনে মনে আপনার রবের জিকির করুন ।
হাদীস ইরশাদ হচ্ছে,
عن سعيد بن ابي وقاص رضى الله تعالى عنه قال قال النبي صلى الله عليه وسلم خير الذكر الخفى وخير الرزق ما يكفى.
অর্থাৎ নবীজী স. বলেন, সর্বোত্তম জিকির হল যা অনুচ্চস্বরে নীরবে করা হয় । আর সর্বোত্তম রিযিক হল যা প্রয়োজন পূরণে যথেষ্ট হয় ।
মোটকথা, আমীন হল দোয়া ও জিকির। আর দোয়া ও জিকিরের ক্ষেত্রে সর্বোত্তম পদ্ধতি হল নীরবে আদায় করা ।
হাদীসে আলোকে আমীন অনুচ্চস্বরে বলার দলীল
১ম দলীল:
অর্থাৎ হাসান রহ. থেকে বর্ণিত যে, একবার হযরত ছামুরা ইবনে জুনদুব এবং ইমরান ইবনুল হুসাইন রা. পরস্পরে আলোচনা করছিলেন। তখন ছামুরা রা. বললেন, আমরা খুব স্মরণ আছে যে, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুই স্থানে নীরব থাকতেন (উচ্চস্বরে কিছু পড়তেন না, যা পড়তেন অনুচ্চস্বরে পড়তেন)। এক স্থান হল, যখন তিনি আল্লাহু আকবার বলে নামাজ শুরু করতেন। আরেক স্থান হল যখন তিনি সূরা ফাতিহা শেষ করতেন। কিন্তু হযরত ইমরান রা. এর প্রতিবাদ করলেন। তখন আমরা উবাই ইবনে কাআব রা. এর নিকট চিঠি লিখলাম। তিনি উত্তরে লিখলেন যে, ছামুরাই এ বিষয়টি সঠিক স্মরণ রেখেছে ।
২নং দলীল :
অর্থাৎ আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত যে, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আল্লাহু আকবার বলে নামাজ শুরু করতেন তখন কিছুক্ষণ নীরব থাকতেন । আর যখন সূরা ফাতিহা শেষ করতেন তখন কিছুক্ষণ চুপ থাকতেন ।
উপরোক্ত দু'টি হাদীস দ্বারা বোঝা গেল যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাজ সর্বদা দুই স্থানে কিছুক্ষণ নীরব থাকতেন (অর্থাৎ উঁচু আওয়াজে কিছু পড়তেন না)। এক, আল্লাহু আকবার বলে নামাজ শুরু করার পর- এ সময় তিনি অনুচ্চস্বরে ছানা পড়তেন । আর দ্বিতীয় স্থান হল, তিনি সূরা ফাতিহা শেষ করে নীরব থাকতেন। উচ্চ আওয়াজে কিছুই পড়তেন না। যা পড়তেন অনুচ্চস্বরে পড়তেন । এখন প্রশ্ন হল, এ সময় তিনি অনুচ্চস্বরে কী পড়তেন? নিশ্চয় আমীন পড়তেন । কেননা, এ সময় হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমীন বলার জন্য সবাইকে আদেশ দিয়েছেন এবং তিনি নিজেও সর্বদা তা পড়েছেন ।
৫। সুফিয়ান ছাওরী রহ. জোরে আমীন বলার হাদীস বর্ণনা করলেও তার আমল ছিল আস্তে আমীন বলা । এতেও প্রমাণিত হয় যে, তিনিও জোরে বলার হাদীসকে শিক্ষা দানের উদ্দেশ্যে ছিল বলে মনে করতেন ।
আমীন বলার ক্ষেত্রে সাহাবা ও তাবেয়ীনদের আমল
আমীন বলার মাসআলায় অধিকাংশ সাহাবায়ে কেরামদের আমল ছিল আমীন অনুচ্চস্বরে বলা । উমর রা., আলী রা., আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. প্রমুখের আমলও তাই ছিল । ইমাম ত্বহাবী রহ. আবু ওয়ায়েল রা. থেকে বর্ণনা করেন যে,
قال كان عمرو على لا يجهر ان "بسم الله الرحمن الرحيم" ولا بالتعوذولا بالتامين.
অর্থাৎ উমর রা. ও আলী রা. বিসমিল্লাহ, আউযুবিল্লাহ এবং আমীন উচ্চ আওয়াজে বলতেন না।
এই হাদীসটির উপর কেউ কেউ আপত্তি করেছেন যে, এই হাদীসের একজন বর্ণনাকারী আবু সাঈদ বাক্কাল মুহাদ্দিসীনদের দৃষ্টিতে দুর্বল। কিন্তু এ কথাটা পুরোপুরিভাবে মেনে নেওয়া যায় না । কেননা, ইমাম তিরমিযী রহ. তার কিতাব علال كبير গ্রন্থে তার ব্যাপারে ইমাম বোখারী রহ. -এর মন্তব্য পেশ করেছেন যে, هو مقارب الحديث. এর দ্বরা বোঝা যায়—তিনি ইমাম বোখারী রহ. এ দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য ছিলেন। তাছাড়া ইবনে জুরাইজ রহ. হাকেম রহ. আবু জুরআ রহ. প্রমুখ শ্রেষ্ট মুহাদ্দিসটিকে দুর্বল বলা ঠিক নয় ।
كنز العمل গ্রন্থের ৪র্থ খন্ডের ২৪৯নং পৃষ্ঠায় ইবনে জারীরের বরাতে উমর রা.- এর একটি বাণী বর্ণনা করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে,
اربع يخفيهن الإمام التعوذ و بسم الله الرحمن الرحيم وآمين واللهم ربنا لك الحمد.
অর্থাৎ ইমাম চারটি বিষয়কে চুপি চুপি আদায় করবে :
১. আউযুবিল্লাহ
২. বিসমিল্লাহ ৩. আমীন
৪. রাব্বানা ওয়া লাকাম হামদ ।
عن ابى وائل قال كان على وعبد الله لا يجهران بسم الله الرحمن الرحيم ولا بالتعوذ ،
ولا بالتامين
অর্থাৎ আবু ওয়ায়েল থেকে বর্ণিত যে, আলী ও ইবনে মাসউদ রা. আউযুবিল্লাহ, বিসমিল্লাহ, আমীন উচ্চ আওয়াজে নামাজে পড়তেন না।
শুধু তাই নয়, ইমাম মালেক (মৃত্যু- ১৭৯ হিজরী ) এর যুগে মদীনা শরীফে ব্যাপক আমল ছিল আমীন অনুচ্চস্বরে বলার, যার প্রেক্ষিতে ইমাম মালেক রহ.- নিজেও আমীন আস্তে বলার মত অবলম্ব করেছেন। আর মদীনার ব্যাপক আমল কেবল তখনই সম্বব যখন অধিকাংশ সাহাবী ও তাবেয়ীন-এর আমল সে অনুযায়ী হয়। মদীনা শরীফে যা ইসলামের প্রধান কেন্দ্র, অধিকাংশ সাহাবা ও তাবেয়ীনের আমল ছিল আমীন আস্তে বলার।
এদিকে ইসলামের দ্বিতীয় প্রাণকেন্দ্র কুফা নগরী যেখানে কমপক্ষে পাচঁশত সাহাবী স্থায়ী নিবাস ছিল এবং যেখানে হযরত আলী রা. তাঁর রাজধানী স্থানান্তর করেছিলেন সেখানেরও সাধারণ আমল ছিল আমীন আস্তে বলার । যার ফলে ইব্রাহীম নাখায়ী ঐ ফল্গুয়া দিয়েছিলেন, যা সামনে উল্লেখ করা হবে। কুফার অধিবাসী ইমাম আবু হানিফা রহ. এর ফাতাওয়াও তারই সাক্ষ্য বহন করে । ইবনে জারীর তাবারী (মৃত্যু-৩১১) সত্যই বলেছেন যে, অধিকাংশ সাহাবী ও তাবিয়ীনের আমল ছিল আমীন আস্তে বলার ।
عن سعيد بن ابي وقاص رضى الله تعالى عنه قال قال النبي صلى الله عليه وسلم خير الذكر الخفى وخير الرزق ما يكفى.
অর্থাৎ নবীজী স. বলেন, সর্বোত্তম জিকির হল যা অনুচ্চস্বরে নীরবে করা হয় । আর সর্বোত্তম রিযিক হল যা প্রয়োজন পূরণে যথেষ্ট হয় ।