সাহাবীদের হাবশায় হিজরতের ঘটনা
06:40:52 01/06/2025
সাহাবীদের হাবশায় হিজরতের ঘটনা
মহানবী সা. নিজের সত্তার উপর সব ধরনের জুলুম ও কষ্ট সহ্য করতেন। কিন্তু যখন সাহাবা কেরাম এবং অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনদের পর্যন্ত এসব কষ্ট গড়িয়ে পড়ল এবং তিনি দেখতে পেলেন যে, তারা অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে সব জুলুম সহ্য করতে প্রস্তুত। কিন্তু এই সত্য বাণী এবং নূরে ইলাহী থেকে তারা মুখ ফিরিয়ে নিতে মোটেই প্রস্তুত নয়, যা মহানবী সা. থেকে তাদের অর্জন হয়েছে। তখন মহানবী সা. তাদেরকে অনুমতি দিলেন যে, তারা যেন হাবশায় হিজরত করে চলে যান।
নবুওয়াত প্রাপ্তির পঞ্চম বছর রজব মাসে বারজন পুরুষ এবং চারজন নারী হাবশার দিকে হিজরত করলেন। যাদের মধ্যে হযরত উসমান এবং তার পুতপবিত্র স্ত্রী হযরত রুকাইয়্যাও ছিলেন। [দুরুসুস সীরাত পৃ ১৫]
সাস্থসম্মত উপায়ে তৈরি ১০০%-খাঁটি-ঘি
হাবশার বাদশাহ নাজ্জাসী এ সব মুহাজিরকে সম্মান করলেন। তারা সকলেই নিরাপত্তা ও শান্তির সাথে সেখানে অবস্থান করতে লাগলেন। যখন কুরাইশদের কাছে ঐসংবাদ পৌঁছল তখন তারা আমর ইবনে আস ও আব্দুল্লাহ ইবনে রবীয়াকে নাজ্জাসীর কাছে পাঠাল এই বলে যে, এরা বিশৃংখলা সৃষ্টিকারী। তাদেরকে নিজ রাজত্বে অবস্থান করতে অনুমতি দিবেন না; বরং তাদেরকে আমাদের হাওলা করুন।
নাজ্জাসী বিচক্ষণ লোক ছিলেন। তিনি তাদের জবাবে বললেন, এ কাজ ঐ সময় পর্যন্ত করতে পারব না যতক্ষণ তাদের ধর্ম ও মতাদর্শসমূহ যাচাই না করব।
নাজ্জাসী মহাজিরগণকে জিজ্ঞেস করলেন যে, স্বীয় ধর্ম এবং উহার সঠিক তথ্য বর্ণনা করুন তখন হযরত জাফর বিন আবু তালিব সম্মুখে অগ্রসর হয়ে বললেন, বাদশাহ, আমরা প্রথমে বর্বর ছিলাম। মূর্তি পূজা করতাম। মৃতপ্রাণী ভক্ষণ করতাম। অশ্লীলতা, আত্মীয়তা ছিন্ন করা, অসৎ চরিত্রে লিপ্ত ছিলাম। আমাদের শক্তিশালীরা দুর্বলদের প্রতি অত্যাচার করত। এক পর্যায়ে আল্লাহ তায়ালা আমাদের নিকট একজন রাসূল প্রেরণ করলেন। তিনি আমাদেরই বংশোদ্ভুত। আমরা তাঁর বংশ, সততা, বিশ্বস্থতা ও পবিত্রতা সম্পর্কে খুব অবগত। তিনি আমাদেরকে ইহার দাওয়াত দিয়েছেন যে, আল্লাহকে এক জানো এবং তাঁর সাথে কোন শরীক ও অংশীদার বিশ্বাস কর না। মূর্তিপূজা বর্জন কর। সত্য বল, প্রিয় ও আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখ। প্রতিবেশির সাথে সুন্দর ব্যবহার কর। মাহরামদেরকে বিবাহ করতে নিষেধ করেছেন। খুনখারাবী করা, মিথ্যা বলা, ইয়াতীমের মাল ভক্ষণ করতে নিষেধ করেছেন। আমাদেরকে নামাজ, রোজা, যাকাত ও হজ্ব করতে আদেশ করেছেন। আমরা যখন শ্রবণ করলাম তখন তাঁর প্রতি ঈমান আনলাম। নাজ্জাসী এগুলো শুনে খুব প্রভাবিত হলেন। কুরাইশদের দূতদ্বয়কে ফিরিয়ে দিলেন এবং নিজে মুসলমান হয়ে গেলেন।
মুহাজিরগণ প্রায় তিন মাস সেখানে নিরাপত্তা ও শান্তির সাথে অবস্থান করে প্রত্যাবর্তন করলেন। সে সময় হযরত ফারুকে আজমও মহানবী সা. এর দুআর বরকতে ইসলাম গ্রহণ করলেন। ঐসময় পর্যন্ত মুসলমানদের আদম শুমারীতে চল্লিশ জন পুরুষ ও এগার জন নারী থেকে অধিক ছিল না। ফারুকে আজম হযরত উমর রা. এর ইসলামে প্রবেশের দ্বারা মুসলমানদের এক প্রকার শক্তি সঞ্চয় হল এবং ঐ সমস্ত লোক, যারা সুস্পষ্ট দলীল দ্বারা ইসলামের সত্যতা বিশ্বাস করে নিয়েছিল; কিন্তু কুরাইশদের উৎপীড়নের ভয়ে ইসলাম প্রকাশ করতে পারত না, এখন প্রকাশ্যে ইসলামে প্রবেশ করতে লাগল। এভাবে আরব গোত্রগুলোতে ইসলাম প্রচার এবং উন্নতি হতে লাগল ।
যখন কুরাইশরা দেখল যে, মহানবী সা. ও তাঁর সাথী-সঙ্গীগণের সম্মান দিন দিন উন্নতি হচ্ছে এবং আবিসিনিয়ার বাদশাহ নিজেও মুসলমানদের সম্মান করেছেন তখন তাদের নিজেদের পরিণাম সামনে আসতে লাগল। কুরাইশরা এই সিদ্ধান্ত নিল যে, বনী আব্দুল মুত্তালিব এবং বনী হাশেমের কাছে দাবী করা হবে যে, তারা স্বীয় ভাতিজা (মুহাম্মদ সা.) কে আমাদের কাছে অর্পণ করবে অন্যথায় আমরা তাদের সাথে সম্পূর্ণ বয়কট করব। কিন্তু বনী আব্দুল মুত্তালিব তা মঞ্জুর করল না। তখন সর্ব সম্মতিক্রমে একটি অঙ্গীকার নামা লিপিবদ্ধ করা হল যে, বনী হাশেম এবং বনী আব্দুল মুত্তালিবের সাথে সম্পূর্ণ বয়কট করা হবে। আত্মীয়তা, বিবাহ-শাদি, ক্রয়-বিক্রয় সব কিছু বন্ধ করে দেয়া হবে। এই অঙ্গীকার নামা বায়তুল্লাহর ভিতরে টাঙ্গিয়ে দেয়া হল।
এক পাহাড়ের ঘাঁটিতে মহানবী সা. এবং তাঁর সকল সাথী ও আত্মীয়দেরকে বন্দী করে দেয়া হল। সে সময় আবু লাহাব ছাড়া বনী হাশেম ও বনী আব্দুল মুত্তালিবের মুসলমান ও কাফের সকল ব্যক্তি আবু তালেবের সাথে ছিল এবং ঐ ঘাঁটিতে অবরুদ্ধ ছিল। সব দিক থেকে রাস্তা বন্ধ ছিল। পানাহারের সামগ্রী যা সাথে ছিল যখন তা শেষ হয়ে গেল। তখন চরম অস্থিরতার মুখোমুখি হলেন। কঠিন ক্ষুধার জ্বালায় গাছের পাতা পর্যন্ত খেতে বাধ্য হয়েছেন। এ অবস্থা দেখে মহানবী সা. দ্বিতীয়বার সাহাবায়ে কিরামকে হাবশায় হিজরতের নির্দেশ দিলেন। এবার একটি বড় দল হিজরত করলেন। যার সংখ্যা ত্রিরাশি জন পুরুষ ও বারজন নারী বর্ণিত আছে । অতঃপর তাদের সাথে ইয়ামেনের মুসলমানগণ মিলিত হলেন। যাদের মধ্যে হযরত আবু মূসা আশআরী রা. এবং তার গোত্রের লোকেরাও ছিল। এ দিকে নবী কারীম সা., বংশের অন্যান্য লোক এবং সাহাবায়ে কিরাম প্রায় তিন বছর জুলুম ও মুসীবতের সাথে জীবন যাপন করছিলেন। এরপর কিছু মানুষ সেই অঙ্গীকার নামা ভাঙতে এবং সেই অবরুদ্ধ উঠিয়ে দিতে প্রস্তুত হল।
ওদিকে মহানবী সা. কে ওহীর মাধ্যমে বলে দেয়া হল যে, সেই অঙ্গীকার নামা উই পোকা খেয়ে ফেলেছে এবং আল্লাহ তায়ালার নাম ছাড়া কোন অক্ষর বাকী নেই। মহানবী সা. মানুষের কাছে তা বর্ণনা করলেন। দেখা হল তো ঠিক সেরকমই পাওয়া গেল, যেরকম মহানবী সা. বর্ণনা করেছেন। মোটকথা, মহানবী সা. থেকে অবরূদ্ধ উঠিয়ে নেওয়া হল।