একসাথে তিন তালাক দিলে কয় তালাক হবে?
15:29:24 12/03/2023
একসাথে তিন তালাক দিলে কয় তালাক হবে?
বিবাহ বন্ধন শরীয়তের বিধান । সমাজবদ্ধ জীবন সুন্দর ও স্বচ্ছ হওয়ার জন্য বিবাহ একটি সুন্দর ব্যবস্থা। পৃথিবীর সকল জাতির মাঝে এ প্রথা বিদ্যমান। কোন মুসলমান যখন বিবাহের ইচ্ছা করে তখন তাকে শরীয়তের নীতিমালা মেনে চলতে হয়, মুসলমানের বিবাহ যদি শরীয়তের পরিপন্থি হয় তাহলে অশুদ্ধ বলে গণ্য হবে এবং স্বামী-স্ত্রীর জৈবিক মিলন যিনা বলে গণ্য হবে।
স্ত্রী যদি অবাধ্য হয়, স্বামীর সাথে মিলেমিশে জীবন যাপনের ইচ্ছা না করে এবং আদর ও সোহাগের সাথে বুঝিয়ে যদি নমনীয় করা না যায়, তাহলে আল্লাহর বিধান `অনুযায়ী তার বিছানা পৃথক করে দিবে এবং প্রয়োজনে চেহারা ব্যতিত অন্য স্থানে হালকা প্রহার করবে। তাতেও যদি সঠিক পথে না আসে তাহলে মহিলাদের ব্যাপারে আল্লাহর সর্বশেষ বিধান তালাকের আশ্রয় গ্রহণ করবে। আর তালাকও কুরআন হাদীসের নিয়মানুসারে দিতে হবে। নিজের মনগড়াভাবে তালাকও দিতে পারবে না । তাই তালাকের সর্বোত্তম পন্থার বর্ণনা দিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
فان أراد أن يطقها فليطلقها حين تطهر من قبل ان يجامعها.
অর্থাৎ যদি কেউ তার স্ত্রীকে তালাক দেয়ার ইচ্ছা করে, তাহলে সে যেন ঐ তুহুরে তালাক দেয়, যে তুহুরে সহবাস করে নাই। এটাই ফকীহগণের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত যে, তালাক দেয়ার সর্বোত্তম ও সঠিক পন্থা হলো, ঐ তুহুরের মধ্যে এক তালাক দিবে যে তুহুরের মধ্যে তার সাথে সহবাস করে নাই ।
روى إبراهيم النخعي قال : كان اصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم ستحسنون أن لا يطلقوا للسنة إلا واحدة ثم لا يطلقونه ذلك حتى تنقضى العدة ، أخرجه ابن أبي شيبة في مصنفه.
হযরত ইবরাহীম নাখায়ী থেকে বর্ণিত । তিনি বলেন, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীরা সুন্নাত হিসাবে এক তালাক দেয়াকে পছন্দ করতেন। এরপর আর তারা তালাক দিতেন না, এভাবেই ইদ্দত শেষ হয়ে যেত ।
হ্যাঁ, যদি কেউ তিন তালাক দেয়ার ইচ্ছা করে তবে তার ব্যাপারে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
ان تستقبل الطهر اسقبالا فتطلقها لكل طهر تطليقة. رواه الدار قطني
আর যদি কেউ এ সুন্নাত পন্থায় খেলাফ করে এক বৈঠকে এক শ্বাসে এবং একই তুহুরে তিন তালাক দিয়ে দেয়, তাহলে তার একাজটি শরীয়তের আলোকে একেবারে অপছন্দনীয় হওয়া সত্ত্বেও আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের ঐক্যমতানুসারে তা তিন তালাক বলে গণ্য হবে । আর স্বামীর জন্যে ঐ স্ত্রী সম্পূর্ণরূপে হারাম হয়ে যাবে, যতক্ষণ না সে অন্য আরেক স্বামীর স্বাদ আস্বাদন করবে (অর্থাৎ বিবাহ ও সহবাস হতে হবে)।
অথচ বর্তমান যামানার তথাকথিত লা-মাযহাবী আহলে হাদীসের ধারণা, স্বামী যদি এক বৈঠকে এক শ্বাসে তিন তালাক দেয়, তাহলে এক তালাক বলে সাব্যস্ত হবে। আর স্বামী চাইলে তাকে ফিরিয়ে নিতে পারবে। তাদের এ ধারণাটা এক ধরনের নব আবিষ্কৃত । কেননা, সাহাবাদের যুগে প্রথমে এ বিষয়ে কিছু মতবিরোধ থাকলেও পরে সকলে এর উপর ঐকমত্য পোষণ করেন ।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. বলেন-
الله
وإن كنت طلقتها ثلاثا فقد حرمت عليك حتى تنكح زوجا غيرك وعصيت فيما أمرك من طلاق امرأتك.
অর্থাৎ যদি তুমি তোমার স্ত্রীকে তিন তালাক দাও তাহলে সে তোমার জন্য অন্য স্বামীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত হারাম। আর তুমি তোমার স্ত্রীর তালাকের ব্যাপারে আল্লাহর বিধান লঙ্ঘন করেছে ।
এ হাদীসে হযরত ইবনে উমরের উদ্দেশ্য এক বৈঠকে তিন তালাক দেয়া । তা না হলে হযরত ইবনে উমরের কথা হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুমোদিত সুরতের সাথে বিরোধ হয়ে যায়। এটা অসম্ভব যে, তিন তুহুরে তিন তালাক দেয়াকে
হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জায়েজ বলেছেন। তাই এটা আদৌ গুনাহের কাজ হতে পারে না; বরং এক শ্বাসে তিন তালাক দেয়াটাই হলো গুনাহের কাজ । এক শ্বাসে তিন তালাক দেয়ার ব্যাপারে আল্লামা ইবনুল হুমাম রহ. বর্ণনা করেন-
وذهب جمهور الصحابه والتابعين من بعد هم من أئمة السلمين إلى أنه يقع الثلاث.
অর্থাৎ প্রায় সকল সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীগণ এবং তাদের পরের সকল ইমামগণ এ রায় পোষণ করেন যে, তিন তালাকই হবে ।
قال : الشافعي ومالك وابو حنيفة واحمد وجما هير من السلف والخلف يقع الثلاث.
অর্থাৎ চার ইমাম, শাফেয়ী ও আবু হানিফা, মালেক ও আহমদসহ (রহ.) পূর্বের ও পরের সকল উলামায়ে কেরাম বলেন যে, তিন তালাক হয়ে যায়।
সহীহ বোখারী শরীফের ব্যাখ্যাকার আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী বলেন-
وقد ذهب جمهور العلماء من التابعين ومن بعدهم منهم الاوزاعي والنخعي والثورى وأبو حنيفة واصحابه ومالك واصحابه والشافعى واصحابه احمد واصحابه وإسحاق وابو ثور وأخرون كثيرون على من طلق إمرأته ثلاثا - وقعته - ولكنه يأ ثم وقالوأمن خالف فيه فهو شاذ مخالف لأهل السنة - وإنما تعلق به أهل البدع - ومن لا يلتفت
اليه لشذوذه من الجماعة - (عمدة القارى)
অর্থাৎ তাবেয়ীগণ এবং তাদের পরে প্রায় সকল উলামায়ে কেরাম যেমন, ইমাম আওযায়ী, ইবরাহীম নাখায়ী, সুফিয়ান সাওরী ও ইমাম আবু হানিফা এবং তার সাথীবর্গ, ইমাম মালেক ও সহসাথীরা, ইমাম শাফেয়ী ও তার সাথীরা, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল ও তার অনুগামীরা, ইমাম ইসহাক ও আবু সাওর ও আবু উবাইদ । তারা সকলেই এ মত পোষণ করেন যে, কোন ব্যক্তি যদি তার স্ত্রীকে এক শ্বাসে তিন তালাক দেয়, তাহলে তিন তালাকই হবে, তবে সে গুনাহগার হবে । আর তারা বলেন যে, এর বিরোধীতাকারীর সংখ্যা খুবই বিরল এবং এটা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের বিরোধী ও বেদআতী । আর তারা ঐ সব লোক যারা মুসলিম জামাত থেকে পৃথক হওয়ার কারণে কেউ তাদের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করে না ।
আল্লামা ইবনুল হুমাম, বদরুদ্দীন আইনী ও আইনী ও ইমাম নববীসহ পূর্বের যুগের হাতেগোনা কয়েকজন ব্যতীত কেউ এ ইজমার কথা অস্বীকার করেন না। মুতায়াখ্যীরিনদের মধ্যে শুধুমাত্র ইমাম ইবনে তাইমিয়া ও তার একমাত্র শাগরিদ আল্লামা ইবনে কায়্যিম এবং আমাদের যামানার তথাকথিত আহলে হাদীস নামধারী লা-মাযহাবীরাই তা অস্বীকার করে ।
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের মাযহাব ও রায়টি কয়েকটি দলীল দ্বারা প্রমাণিত।
১. আল্লাহ পাক বলেন-
الطَّلَاقُ مَرَّتَانِ فَإِمْسَاكُ بِمَعْرُوفٍ
অর্থাৎ তালাক দুইবার, মুফাসিরগণ এই আয়াতের ব্যাখ্যায় দুটি শানে নুযুল বর্ণনা করেন । ইমাম বায়হাকি ও ইমাম ইবনে মারবিয়্যাহ হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণনা করেন-
عن عائشة رضى الله عنها قالت لم يكن للطلاق وقت يطلق الرجل أمرأته ثم يرجعها ما لم تنقض العدة فوقت لهم الطلاق ثلاثا يرجعها فى الوحدة او الثنتين
وليس في الثالثة رجعة حتى تنكح زوجا غيره (تفسير ابن كثير : ج۱۱، ص۷۷)
অর্থাৎ হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত । তিনি বলেন, প্রথম যুগে তালাকের কোন নির্দিষ্ট সময়সীমা ছিল না। কেউ তার স্ত্রীকে তালাক দিলে ইদ্দত শেষ হওয়ার পূর্বে তাকে ফিরিয়ে নিত । এজন্য তিন তালাককে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। সে তার স্ত্রীকে যদি এক তালাক দেয় অথবা দুই তালাক দেয় তাহলে ফিরিয়ে নিতে পারবে। আর তিন তালাক দিয়ে দিলে ফিরিয়ে নিতে পারবে না যতক্ষণ না সে অন্য স্বামীর স্বাদ আস্বাদন করবে ।
ইমাম তাবারী রহ. তাফসীরে তাবারীতে বর্ণনা করেন-
فتاويل الآية على هذه الخبر الذي ذكرنا عدد الطلاق الذي لكم أيها الناس فيه على ازواجكم الرجعة إذا كان مدخولا بهن تطليقتان ثم الواجب بعد التطليقتين امساك بمعروف أو تسريح باحسان لأنه لا رجعة له بعد التطليقتين إن سرحها فطلقها الثلاثة.
অর্থাৎ উপরোল্লেখিত শানে নুযুল অনুযায়ী আয়াতের ব্যাখ্যা হলো, হে লোকেরা! যে সব তালাক দ্বারা তোমাদের স্ত্রীদের উপর তোমাদের বিবাহ বন্ধন বহাল রাখার অধিকার থাকে – তাহলো তাদেরকে দুই তালাক দিবে- যদি তাদের সাথে তোমাদের মিলন হয়ে থাকে । আর দুই তালাকের পর সুন্দর পন্থায় ইচ্ছা হলে রাখতে পার ।
অথবা ন্যায়নিষ্ঠার সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটিয়ে তাকে পৃথক করে দিতেপার । কেননা, দুই তালাকের পর বিবাহ বন্ধনে রাখার কোন অধিকার থাকে না। যদি সে অন্য আরেক তালাক দিয়ে দেয়।
সারকথা হলো, জাহেলী যুগে লোকদের যত তালাক দিতে ইচ্ছে হত তাই দিত, আবার যখন স্ত্রীকে বিবাহ বন্ধনে রাখতে ইচ্ছে হত তখন রাখত । তাই আল্লাহ পাক তাদের এ জাহেলী প্রথা বাতিল করে তালাকের সঠিক বিধান প্রধান করেন এবং তালাক ও স্ত্রীকে বিবাহ বন্ধনে রাখার সীমারেখা নির্ধারণ করেন। তালাকের সীমা তিন পর্যন্ত । আর স্ত্রীকে বিবাহ বন্ধনে রাখার সীমা তিন তালাকের আগ পর্যন্ত ।
অন্যান্য মুফাসিরগণ এ আয়াতের অন্য আরেকটি শানে নুযুল বর্ণনা করেন-
وقال : الأخرون إنما نزلت هذه الأية على نبي الله صلى الله عليه وسلم - تعريفا من الله تعالى عباده سنة طلا قهم نسائهم إن اراد واطلا قهن لا دلالة على العدد الذي تبين به المرأة منزوجها. وتاويل الأية على قول هولاء - سنة الطلاق التي سنتها وابحتها لكم إن اردتم طلاق نسائكم ان تطلقو هن ثنتين في كل طهر واحدة ثم الواجب بعد ذلك عليكم اما أن تمسكم من بمعروق او تسريح با حسان (تفسیر طبری :
ج ٣ ص ٢٥٩)
অর্থাৎ অন্যান্য মুফাসিরগণ বলেন, এ আয়াতে আল্লাহর পক্ষ থেকে তার প্রেরিত রাসূলের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপর নাযিল হয়েছে— তার বান্দাদের মধ্য থেকে যারা তাদের স্ত্রীদের তালাক দেয়ার ইচ্ছা করে তাদেরকে তালাকের সুন্দর বৈধপন্থা শিখানোর জন্যে । আর আয়াতে এমন কোন সংখ্যা বর্ণনা করা হয় নাই যা দ্বারা(-স্ত্রী-স্বামী থেকে পৃথক হয়ে যায়। আর তাদের গবেষণা অনুযায়ী আয়াতের ব্যাখ্যা হল, যখন তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের তালাক দিতে চাও, তখন তাদেরকে দুই তুহুরে দুই তালাক দাও। এরপর ইচ্ছে হলে সুন্দর ও ন্যায়সঙ্গত পন্থায় তোমরা তাদেরকে কাছে রাখতে পার, আর ইচ্ছে হলে ন্যায়নিষ্ঠার সাথে বিবাহ বন্ধন ছিন্ন করে দিতে পার ।
শানে নুযুলের প্রতি লক্ষ্য করলে আয়াতের দুটি ব্যাখ্যা হতে পারে-
১. উক্ত আযাতে তালাকের সংখ্যা ও শেষ তালাকের সীমা বর্ণনা করা হয়েছে।
২. উক্ত আয়াতে তালাক দেয়ার পদ্ধতি ও সঠিক নিয়ম বর্ণনা করা হয়েছে। অর্থাৎ পৃথক পৃথক তুহুরে, যে তুহুরে সে সহবাস করে নাই, পৃথক পৃথক তালাক দিবে ।
আল্লামা ইবনে জারীর তাবারী ও মুজাহিদ এবং আল্লামা ইবনে কাসীর রহ. এ মত পোষণ করেন। তবে ইমাম রাযী রহ. প্রথম মতকে গ্রহণ করেছেন। আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ুতী রহ. এ মতকে নযমে কুরআনের সাথে অধিক সামঞ্জস্য বলে উল্লেখ করেছেন এবং শানে নুযুলের সাথে অধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে দাবি করেন।
প্রথম তাফসীর অনুসারে আয়াতের অর্থ ব্যাপক, চাই তা এক বৈঠকে হোক বা ভিন্ন ভিন্ন বৈঠকে । তাই ১৩, এর অর্থ হবে, দুই তালাক এক শ্বাসে হোক বা দুই শ্বাসে হোক। এক স্থানে হোক বা দুই স্থানে। কিন্তু দ্বিতীয় তাফসীর অনুসারে আয়াতের অর্থ হলো, দুই তুহুরে দুই স্থানে দুই শ্বাসে তারাক দেয়া
মাদারিকুত তানযিলের মুসান্নিফ রহ. বলেন-
ولم يكن بالمرتين التثنية ولكن التكرير
অর্থাৎ‘মাররা তাইন’ শব্দের দ্বারা দুই তারাক বোঝানো হয় নাই; বরং দুইবার তালাক বোঝানো হয়েছে ।
কাজী সানাউল্লাহ পানিপথি রহ. বলেন, আয়াতের অর্থ হচ্ছে, তালাকে শরয়ী হল তুহুরাবস্থায় এক তালাকের পর পরবর্তী তুহুরে আবারো তালাক দেয়া । যা একসাথে না হয়।
তাই এ আয়ত থেকে কখনো একথা প্রমাণ করা সম্ভব হবে না যে, এক শ্বাসে তিন তালাক দিলে এক তালাক হবে। আর বাকিগুলো নিস্ফল। সুতরাং উল্লিখিত আলোচনা থেকে আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারলাম যে, কেউ একসাথে তিন তালাক দিলে তিন তালাকই হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সঠিক জ্ঞান দান করুন এবং শয়তানের চক্রান্ত থেকে হেফাজত করুন।