মূর্তি পূজার সূচনা ও নূহের (আঃ) সংগ্রাম
12:02:35 12/03/2023
মূর্তি পূজার সূচনা ও নূহের (আঃ) সংগ্রাম: হাদীসের কিতাব পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, হযরত নূহ (আঃ) তাঁর সম্প্রদায়কে সাড়ে নয়শত বছর আল্লাহর দিকে আহ্বান করেছেন। তিনি বলেছেন,
ياقوم اعبدو الله مالكم من اله غيره
“হে আমার জাতি, আল্লাহ ছাড়া তোমাদের কোন প্রভু নেই।”” একথার স্বীকৃতি দাও যে, এই পুরো জগতকে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই । নূহ (আঃ) এর জাতি নূহ (আঃ) কে বলেছে-
হে নূহ, তুমি তোমার প্রভুর একত্ববাদ বিশ্বাস করানোর জন্য আমাদের সাথে অনেক তর্ক করেছ, এখন তোমার সেই প্রভু কোন ক্ষমতা থাকলে আমাদের কিছু ক্ষতি কর। দেখি তোমার প্রভু আমাদের কি ক্ষতি সাধন করতে পারে।'
নূহ (আঃ) এর জাতি সর্বপ্রথম মূর্তিপূজা করেছে, কিভাবে মূর্তি পূজা করেছে? এ প্রসঙ্গে বুখারী শরীফের বর্ণনায় হযরত ইবনে আব্বাসের হাদীস আছে । নূহ (আঃ) এর যুগে যারা বুযুর্গ লোক ছিল তারা মারা যাওয়ার পর শয়তান তাদের মনে কুমন্ত্রণা দিলো, তোমরা কি তোমাদের সেই বুযুর্গ লোকদের ভুলে যাবে। তাদের তো তোমাদের উপর অনেক অবদান আছে । তোমরা তাদের ছবি তৈরী কর, তাহলে তাঁদের অবদানের কথা তোমাদের মনে পড়বে ।
এটা ছিল প্রথম কুমন্ত্রণা । ওই জেনারেশন যখন চলে গেল, অন্য জেনারেশন আসলো তখন শয়তান আবারো কুমন্ত্রণা দিলো, বলল শুধু কি ছবিগুলো সযত্নে রাখলে তাঁদের যথাযথ মর্যাদা আদায় হবে? তোমরা নামাজের সময় তাদের ছবিগুলো তোমাদের সামনে রাখ, যেন তাদের বিদেহী আত্মার কথা নমাজের সময় তোমাদের মনে পড়ে । এই জেনারেশনও চলে গেল। তারপর ৩য় জেনারেশন এলো। তাদেরকে বলল, শুধু নামাজের সময় সামনে রাখলে হবে না বরং অন্য সময়ও রাখতে হবে, এবং নামাজের সময় তাদের কথা কল্পনা করতে হবে । আর শুধু ছবিই যথেষ্ট নয়, বরং তাদের একটা স্থায়ী ভাস্কর্য নির্মাণ করতে হবে, যেন পরবর্তী জেনারেশন এসে তাদের ভাস্কর্য আর মূর্তিগুলোকে যত্ন করে ও গভীরভাবে তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে। ইসলামে কোন ওলী, পীর বুযুর্গকে সম্মান প্রদর্শনের জন্য ছবি নির্মাণ করার অনুমতি নেই । ইসলাম পিতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করার জন্য তার ছবি ঘরে টাঙ্গানোর অনুমতি দেয়নি ।
রাজনৈতিক নেতাকে স্মরণ করার জন্য ঘরে ছবি টানানোর অনুমতি নেই। যদি ছবি টানানোর অনুমতি থাকত তাহলে সর্বপ্রথম মহানবী (সাঃ) এর ছবি টানানোর নির্দেশ দেয়া হতো। কেননা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশী সম্মান, শ্রদ্ধা পাওয়ার অধিকারী হলেন মহানবী (সাঃ)। সাহাবাদের অন্তরে মহানবী (সাঃ) এর ভালবাসা সবচেয়ে বেশি ছিল। আপনারা জানেন আল্লাহর নবী যখন পৃথিবীর বুক থেকে ইন্তেকাল করলেন, তখন এক সাহাবা জমিতে চাষ করছিলো । যখন তিনি তাঁর (সাঃ) মৃত্যুসংবাদ শুনলেন আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করলেন, হে আল্লাহ আমার সে চক্ষুদ্বয়ের দৃষ্টি শক্তি ফিরিয়ে নিন যে চক্ষু দ্বারা আমি মহানবী (সাঃ) কে দেখেছিলাম। এখন তিনি আর নেই এই চোখ দিয়ে আর কিছু দেখতে চাইনা। তাহলে অনুধাবন করা যায়, মহানবীর (সাঃ) প্রতি তাদের ভালবাসা কি পরিমাণ ছিল । যদি ছবি নির্মাণ করা এবং ভাস্কার্য তৈরী করা শূণ্য হত তাহলে মহানবীর (সাঃ) ছবি ও ভাস্কর্য তৈরী করা হত ।
শয়তান মানবতাকে ধ্বংস করার জন্য হযরত নূহ (আঃ) এর উম্মতকে ছবি নির্মাণের মাধ্যমে বোকা ও প্রতারিত করেছিল। ধীরে ধীরে তা ভাস্কর্যে পরিণত হয়েছিল। পরবর্তীতে সেই ভাস্কর্যগুলোকে শয়তান তার প্ররোচনার মাধ্যমে উপাস্যে পরিণত করেছে । শয়তান নূহ (আঃ) এর সম্প্রদায়কে বলেছিল এরাই তোমাদের উপাস্য আর মাবুদ। শয়তান পাঁচজন বুযুর্গের ছবি নির্মাণ করিয়েছিল, ধীরে ধীরে সেই ছবিগুলো উপাস্য আর মা'বুদে পরিণত হয়েছে। সেই থেকে পৃথিবীর ইতিহাসে, মানবতার ইতিহাসে মূর্তিপূজার সূচনা, মুশরিক এবং শিরিকের সূচনা হয় । হযরত নুহ (আঃ) এর জাতি বিপথে চলে গেল, নূহ (আঃ) তাঁর সম্প্রদায়কে দাওয়াত দিতে থাকলেন-
ياقوم اعبدوا الله مالكم من اله غيره
হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা মূর্তিপূজা ছেড়ে এক আল্লাহর উপাসনা কর। নূহ (আঃ) এর সম্প্রদায় নূহকে দেখলে মুখে কাপড় দিতো। এরপরও তিনি তাদেরকে দাওয়াত দেওয়া থেকে বিরত থাকেননি। নূহ (আঃ) এর সম্প্রদায় তাঁর কথা না শুনার জন্য কানে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিতো। এরপরও তিনি তাদেরকে দাওয়াত দিতেন। সাড়ে নয়শত বছর তিনি এভাবে দ্বীনের দাওয়াত দিলেন।
এরপর আল্লাহ নির্দেশ দিলেন, হে নূহ! তুমি একটি জাহাজ নির্মাণ কর, আমি এক মহাপ্লাবন দিয়ে তাদেরকে ধ্বংস করে দেব। হযরত নূহ (আঃ) বিশালাকারে জাহাজ নির্মাণ করছিল। তাঁর সম্প্রদায়ের লোকেরা যখন পাশ দিয়ে যাচ্ছিল তখন বলল, হে নূহ, এত বিশাল জাহাজ তুমি কোথায় চালাবে, সমুদ্র তো এখান থেকে বহুদূরে।
তুমি কি এ জাহাজ রাস্তায় চালাতে চাও? আমরা এতদিন তোমাকে পাগল বলেছি, কিন্তু এর কোন স্পষ্ট প্রমাণ দেখাতে পারিনি।” আজ প্রমাণ হয়ে গেল তুমি পাগল। রাস্তায় চালানোর জন্য জাহাজ নির্মাণ করছ।
কোরআনে কারীমে স্পষ্ট আছে, হযরত নূহ (আঃ) এর সম্প্রদায়কে আল্লাহ মহাপ্লাবন দ্বারা ধ্বংস করেছেন। আর হযরত নূহ (আঃ) কে সেই বিশাল জাহাজের মাধ্যমে রক্ষা করেছেন। হযরত নূহ (আঃ) রজবের এক তারিখে জাহাজে উঠেছিলেন এবং মহরমের দশ তারিখ ইরাকের (যুদি) পাহাড়ে যখন জাহাজটি আটকে যায় তখন জাহাজ থেকে নেমে পড়েন। তাহলে রজব মাসেই হযরত নূহ (আঃ) জাহাজে উঠেন।
সুতরাং রজব মাসের একটি আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। রজব মাসের এক তারিখ ও দশ তারিখ বরকতময়। এ দিনে আল্লাহ নূহ (আঃ) কে রক্ষা করেছেন, আর শিরিককারীদের মহাপ্লাবন দিয়ে ধ্বংস করেছেন। কাজেই এই মাস মুশরিকদের পরিণাম ফল স্মরণ করার মাস। মহান আল্লাহ বলেন, বিভিন্ন জাতির উত্থান-পতনের দিন সমুহের কথা হে নবী, আপনি স্মরণ করিয়ে দিন।
ছবি টাঙ্গিয়ে সম্মান প্রদর্শন ইসলাম সম্মত নয়
মুসলমান ভায়েরা, আমাদের নেতা থাকতে পারে, পীর, গুরু থাকতে পারে ওস্তাদ থাকতে পারে, তবে তাদেরকে এমন ভাবে সম্মান প্রদর্শন করা যাবেনা, যা ইসলাম পরিপন্থী । তাহলে আমাদের পরিণামফল হবে নূহ (আঃ) এর জাতির ন্যায় যতবড় নেতাই হোক নিজের ঘরে তাঁর ছবি ঝুলিয়ে রাখা যাবেনা । সাহাবায়ে কেরাম আল্লাহর নবীর কোন ছবি টাঙ্গিয়ে রাখেননি। ঘরে ছবি টানানোর মাধ্যমে রহমতের ফেরেশতার প্রবেশকে বাধা দেবেন না। এটা শ্রদ্ধা প্রদর্শন নয়, এটা যদি শ্ৰদ্ধা হতো তাহলে ইসলাম নিষেধ করতনা । ছবি নির্মাণ, ভাস্কর্য নির্মাণ ও পুতুল নির্মাণের অনুমতি ইসলামে নেই । মুসলমানের ঘর, তার সোকেজ বা ড্রইং রুম সাজানোর জন্যে পুতুল ক্রয় করার বা সংগ্রহ করার অনুমতি নেই । পুতুল দিয়ে সোকেজ সাজানো রহমতের ফেরেশতা প্রবেশে বাঁধা প্রদান করার নামান্তর, এটি এক ধৃষ্টতা। মুসলমান কখনো এ কাজ করতে পারেনা ।
ছবি নয় বই চাই
স্পেনের বাজারে একটি বই বিক্রি হচ্ছিল, দু'জন ব্যক্তি সেই বই ক্রয় করার জন্য আগ্রহী হল । একজন লোক বলল, আমিতো এই বই বহুদিন যাবৎ খুঁজছি, আজ পেলাম । আরেকজন অশিক্ষিত ধরনের লোক বইটি সেই গবেষকের চেয়ে বেশি দামে ক্রয় করে নিল। গবেষক চিন্তা করল এই বিষয়ে তো আমার চেয়ে বেশি গবেষণা করার মত লোক নেই। তাহলে এই লোক কেন এই বই ক্রয় করল। গবেষক লোকটিকে জিজ্ঞেস করল, ভাই, এই বিষয়ে তো আমিই। গবেষণা করছি । আপনি এই বইটি কেন ক্রয় করলেন। আপনিও কি এ বিষয়ে গবেষণা করছেন। লোকটি বলল, না আমি গবেষণা করছি না। তবে আমি লাইব্রেরী দিয়ে আমার যে ড্রইংরুম সাজিয়েছি, তার মধ্যে একটু জায়গা খালি আছে, সেই খালি জায়গা পূর্ণ করার জন্য সে সাইজের কোন বই পাচ্ছিলাম না, আজ পেয়ে গেলাম।" লোকটি অবাক হল। মুসলমানরা যখন বই দ্বারা নিজেদের ড্রইং রুমকে সাজাতো, বইয়ের প্রতি ছিল তাদের প্রবল আকর্ষণ তখন তারা সারা পৃথিবীর নেতৃত্ব দিয়েছিল । মুসলমানরা ড্রইংরুম সাজাবে কোরআন দিয়ে, বই দিয়ে । পুতুল দিয়ে নয়। রজব মাসকে আল্লাহ গুরুত্ব দিয়েছেন ।
কারণ, এর সাথে জড়িয়ে আছে মূর্তি পূজার ইতিহাস, ধ্বংসাত্মক পরিণামের * ইতিহাস । ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর এই হাদীস সকলকে স্মরণ রাখা উচিৎ, মূর্তি পূজার উদ্ভব ঘটেছিল অতি ভক্তি থেকে, আল্লাহর ওলীদের প্রতি সম্মান দেখাতে গিয়ে । আমাদের খেয়াল রাখা উচিৎ, তাদেরকে যেন আল্লাহর রাসূলের পর্যায়ে নিয়ে না যাই । কোন মানুষকে সিজদা করা, তার গোসল করা পানি দিয়ে শরীরে মাখানো, ওলীদের কবরের চারদিকে তাওয়াফ করা এবং তাকে বাইতুল্লাহর তাওয়াফ মনে করা ইসলামে জঘন্য অন্যায় । এই ধরনের লোকের জন্য ধ্বংস অনিবার্য । যখন কোন ওলীর কবরে গিয়ে তবলা বাজানো হয়, মশাল জালানো হয়, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা হয় তখন তা আল্লাহ ও তার রাসুলের প্রদর্শিত পথ থেকে বিচ্যুরিত কারণ হয়। এটি শ্রদ্ধা আর ভক্তি নয়, এটি ভন্ডামি ।
এর ফলে আল্লাহর ওলীদের বদদোয়া আর অভিশাপ অর্জিত হয়। কিয়ামতের ময়দানে আল্লাহর ওলী জিজ্ঞেস করবে, আমি কি বলেছিলাম আমার কবরে মশাল দেয়ার জন্য, সিজদা দেয়ার জন্য। ওলীর সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য আপনি সিজদা করছেন এটাই হবে আপনার জন্যে কাল। মুসলমান ভায়েরা, ঈমান আকীদাকে হেফাজত করতে হবে। হযরত নূহ (আঃ)-র ইতিহাস আমাদের স্মরণে রাখতে হবে। হযরত নূহ (আঃ) হচ্ছেন দ্বিতীয় আদম, প্রথম আদম হচ্ছে হযরত আদম (আঃ), ২য় আদম হযরত নুহ (আঃ)। তিনি মানবতার দ্বিতীয় পিতা।