খন্দকের যুদ্ধ ও বনু কুরাইজার গাদ্দারী - Battle of Khandak and Banu Qurayza
05:46:30 12/10/2023
খন্দকের যুদ্ধ ও বনু কুরাইজার গাদ্দারী : বনূ কায়নাকা নির্বাসিত। নির্বাসিত বনু নাযীরও। মদীনার উপকণ্ঠে ইহুদী বলতে আছে শুধু বনূ কুরাইজা। সতীর্থদের, স্বজাতিদের ভাগ্যদর্শনে তারাও নিজেদের অবস্থান ও ভবিষ্যত নিয়ে ভাবছিল। কোন জুতসই মওকার অপেক্ষা করছিল। তাদেরও এ সংশয় প্রস্তুতি সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম ওয়াকেফ ছিলেন যথাযথ। রীতিমত তাদের প্রতি লক্ষ্য রাখার জন্য লোক নিযুক্ত করে রেখেছিলেন। যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করার লক্ষ্যে দুইশ' জানবাজ মুজাহিদের একটি স্পেশাল ফোর্সও তৈরি করে রেখেছিলেন।
এদিকে খায়বারে নির্বাসিত ইহুদীরাও তো ছেড়ে দেয়ার পাত্র নয় । তাই তারা ভবিষ্যত পরিকল্পনাকে সামনে নিয়ে রীতিমত যোগাযোগ বজায় রাখছিল মক্কার কাফেরদের সাথে। তাদেরকে নানাভাবে মদীনার জানবাজ মুজাহিদদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে উদ্বুদ্ধ করছিল প্রতিনিয়ত। গাদ্দার ইহুদীদের দুই শিবির মদীনার উপকন্ঠ নিবাসী আর নির্বাসিত খায়বার গোষ্ঠীর অন্দর বাহির ষড়যন্ত্রের মুখে সার্বক্ষণিক প্রস্তুত থাকতে হচ্ছিল হযরত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং জাঁনেছার সাহাবায়ে কেরামের বিপ্লবী কাফেলাকে!
খন্দকের যুদ্ধ
খায়বারে নির্বাসিত ইহুদীদের প্ররোচণায় পরাজিত কাফের গোষ্ঠীর মৃত মন চাঙ্গা হয়ে ওঠে, শত্রুতার ভোঁতা বিশ্বাস শানিত হয়ে ওঠে পুনর্বার। অবশেষে হিজরী পঞ্চম সালে দশ হাজার সশস্ত্র বাহিনীর বিশাল দল পবিত্র মদীনার উদ্দেশ্যে রওনা হয় ।
হযরত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যথাসময়ে সংবাদ পান। সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে পরামর্শে বসেন। প্রিয় নবীজীর বিজ্ঞতম প্রিয় সাহাবী সালমান ফারসী (রা.)-এর পরামর্শে মদীনার চারপাশে পরিখা খনন করে বেঈমানদের মোকাবেলা করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ইতিহাসে এই যুদ্ধকে খন্দকের যুদ্ধ নামে স্মরণ করা হয় ।
দীর্ঘ বিশ দিন পর্যন্ত পবিত্র মদীনাকে ঘেরাও করে রাখে বেঈমানেরা। এরই মধ্যে একদিন তারা মুসলমানদের উপর পাথর বর্ষণ শুরু করে দেয়। মুসলমানগণ পূর্ণ প্রাণ ও উৎসাহের সাথে মোকাবেলা করতে থাকেন। মুসলমানদেরকে এদিকে ব্যস্ত থাকতে দেখে এই সুযোগে মদীনার মুসলিম নারীগণ যে স্থানটায় অবস্থান করছিলেন বনূ কুরায়যার ইহুদীরা সেখানে হামলা করে বসে । অথচ তাদের জানা ছিল না, তাদের হামলাটা হচ্ছে ঈমানের উপর । হোক না সে ঈমানের ধারক নারী কিংবা বুড়ো। কুফুরীতো ঈমানকে পরাজিত করতে পারে না। তাই হামলা হতেই দীপ্ত প্রতিবাদে ফেটে পড়লেন বীরাঙ্গনা নারীগণ। শানিত চেতনা, জিহাদী বিশ্বাস, ঈমানী বীর্য আর বিপ্লবী প্রতিরোধের এক ধাক্কায় ইহুদীরা লেজ পিঠে ফেলে ভুঁ ছুট । তারপর ইঁদুর ইহুদীদের কেউ আর ওইদিকে মাথা ওঠাবারও হিম্মত করেনি।
তারপর মুসলমানদের প্রতি আল্লাহ তাআলার করুণা ও অনুগ্রহের বৃষ্টি হয়েছে। ইহুদী-মুশরিকদের ঐক্যে চিড় ধরেছে। রাতে প্রবল ঝড় ওঠেছে। মুশরিকদের তাবু লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। কনকনে শীতের প্রকোপে পড়ে তাদের পলায়ন ছাড়া আর কোন গতি ছিল না তখন। অতঃপর এভাবেই ঘেরাও কর্মসূচি ভেস্তে গেছে। জ্বলে রয়েছে সত্যে দীপ পূর্ণ উদ্যমে, পূর্ণ স্বকীয়তায়। যে প্রদীপের রক্ষা প্রাচীর ক্ষিপ্র ঝড়ের স্বয়ং হাওয়া সেই প্রদীপ কি নিভতে পারে জ্বেলেছেন যা আল্লাহ তাআলা ।
খন্দক যুদ্ধ থেকে অবসর হওয়ার পর হযরত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনূ কুরায়যার গাদ্দারী ও বেঈমানীর উচিত শিক্ষা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং সাহাবায়ে কেরামকে তাদের উপর হামলা করার নির্দেশ দিলেন। নির্দেশ পেতেই সাহাবায়ে কেরাম (রা.) প্রস্তুত। বিশেষ করে নারীদের উপর হামলা করায় সাহ- াবীদের মনে প্রতিশোধের অগ্নিশিখা তখন দাউ দাউ করে জ্বলছিল। সিদ্ধান্ত মাফিক অন্ধ সাহাবী আবদুল্লাহ ইবন উম্মে মামকতুম (রা.) কে মদীনায় স্বীয় স্থলাভিষিক্ত করে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু কুরায়যাকে ঘেরাও করেন। দীর্ঘ পঁচিশ দিন অবরুদ্ধ থাকার পর বাধ্য হয়ে বনু কুরাইজা আত্মসমৰ্পণ করে এবং বলে আল্লাহর রাসূল যে ফায়সালা দিবেন আমরা ভাই মেনে নেব।
তাদের এই আত্মসর্পণের পর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খেদমতে হাজির হলো বনূ আউসের লোকেরা। তারা আরয করলো, হে রাসুল! বনু কুরাইজাতো আমাদের হালীফ -সন্ধিবদ্ধ গোত্র। তাই আমাদের অনুরোধ, যেভাবে ইতিপূর্বে আযরাজীদের অনুরোধে বনু নাযীরের সাথে যেমন আচরণ করেছেন আমাদের অনুরোধ এই বনূ কুরাইজার সাথেও অনুরূপ আচরণ করবেন। এদিকে বনু কুরাইজার ইহুদীরা হাতিয়ার ফেলে দিয়ে নিবেদন করলেন আমাদের সম্পর্কে বনূ আউসে সরদার 'সা'দইবন মুআয যে ফয়সালা দিবেন আমরা তা মেনে নেব।
হযরত সাদ ইবন মুআয (রা.)-এর সাথে ইহুদীদের সম্পর্ক দীর্ঘ দিনের। ব্যবসায়িক সম্পর্ক তো ছিলোই। তার উপর বন্ধু কবীলার সরদার বলেও এদের কাছে হযরত সাদ (রা.)-এর গুরুত্ব অনেক বেশি। তাই ইহুদীরা ভেবেছিল, দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব ও তেজারতি সম্পর্কের কারণে হযরত সাদ নিশ্চয়ই তাদের সাথে নরম ব্যবহার করবেন ।
সদ্য সমাপ্ত খন্দক যুদ্ধে হযরত সাদ (রা.) মারাত্মকভাবে আহত হন। তাই মসজিদে নববীর পাশেই একটি তাবুতে তিনি অবস্থান করছিলেন। ইহুদীদের গাদ্দারী ও বেঈমানীর কথা শোনে তিনি খুবই আঘাত পান। কিন্তু বনূ আউসের সুপারিশ ও ইহুদীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে হযরত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত সাদ (রা.) কেই বিচারক নির্ধারণ করেন।
হযরত সাদ (রা.) তখন ইহুদী নেতাদেরকে ডেকে পাঠান। ডেকে জিজ্ঞেস করেন, তোমাদের এই সংকটের নিরসন কি পবিত্র কুরআনের আলোকে করব না তোমাদের কিতাব তাওরাতের আলোকে করব? তারা জোর দিয়ে বলতে থাকে, আমাদের বিচার আমাদের গ্রন্থ মতোই করুন। তখন হযরত সাদ ইবন মুআয (রা.) বলেন তোমাদের তাওরাত গ্রন্থের 'ইসতিসনা' নামক অধ্যায়ে আছে।
'যখন তুমি কোন শহরে আক্রমণ করতে যাবে তখন প্রথমে সন্ধির প্রস্তাব দিবে। যদি তারা প্রস্তাব মেনে নিয়ে দরোজা খুলে দেয় তাহলে সেখানে অবস্থানরত সকলেই তোমার দাস-দাসী হয়ে যাবে। আর যদি সন্ধি করতে নারাজ হয় তাহলে তাদেরকে অবরোধ করবে। তারপর তোমার প্রভু যখন তাদেরকে তোমার নিয়ন্ত্রণে এনে দিবেন তখন উপস্থিত সকল পুরুষকে হত্যা করে ফেলবে এবং বয়স্ক পুরুষ ব্যতীত শিশু নারী জানোয়ার ইত্যাদি যা অবশিষ্ট থাকবে তার সবগুলোই তোমার জন্যে গনীমত- যুদ্ধলব্ধ সম্পদ হিসাবে বিবেচিত হবে।
তাওরাতের এই বিধান মাফিক হযরত সাদ (রা.) স্বীয় সিদ্ধান্তের কথা সকলকে শুনিয়ে দেন। বলে দেন, ইহুদীদের মধ্যে যুদ্ধ করতে সক্ষম এমন সব পুরুষকে হত্যা করে ফেলা হবে। আর শিশু এবং নারী হবে বন্দী। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত সাদ (রা.)-এর ফয়সালাকে অনুমোদন করেন। হযরত সাদ (রা.) এর ফয়সালা মুতাবিক ছয় শত ইহুদীকে হত্যা করা হয়। অবশ্য হযরত সাদ (রা.) এই রায় প্রদান করার পরের দিনই শাহাদত বরণ করেন।
● হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর জিহাদী জীবন