Narrow selection

​​​​​​​ইহুদি ষড়যন্ত্রের সূচনা - Beginning of the Jewish Conspiracy


06:15:57 12/10/2023

ইহুদি ষড়যন্ত্রের সূচনা : শুরুতে ইহুদিরা মুসলমান ও মুশরিকদের সম্পর্কে ছিল অনেকটা বেখবর। তারা এদিকে খুব একটা মনোযোগ দেওয়ারও সময় পেত না। এক কথায় তারা ছিল সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ। কিন্তু ইসলাম ও মুসলমানরা মদীনায় যাওয়ার পরে এই নিরপেক্ষ ইহুদিরা ধীরে তাদের বিরুদ্ধে দুশমনি করতে আরম্ভ করে। বরং শুরুতে ইহুদিরা মুসলমানদেরকে তাদের আরও কাছের লোক মনে করত। কেননা বিস্তারিত ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে বেশকিছু মতবিরোধ ও বিভিন্নতা থাকলেও আম্বিয়ায়ে কিরামের ওপর ঈমান, কিয়ামত ও পুনরুত্থানের ওপর বিশ্বাস স্থাপন ইত্যাদি দিক দিয়ে মুসলমান ও ইহুদিরা একই আকীদা পোষণ করত।

যদিও বছরের পর বছর ধরে জাহেলী আর পৌত্তলিক সমাজ ঘেঁষে বসবাস করার কারণে ইহুদিদের মধ্যে বেশকিছু কুসংস্কার আর অমূলক ধ্যান-ধারণার অনুপ্রবেশ ঘটেছিল, যদিও বেশকিছু নবীর ব্যাপারে তারা প্রচণ্ড বাড়াবাড়ি আর পবিত্রতার মিছিল করত, বাদবাকি আল্লাহ তাআলার একত্ববাদ, তাঁর গুণাবলী তাওহীদের স্বচ্ছ বিশ্বাসের দিক দিয়ে মুসলমানদের দুনিয়ার সমস্ত জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সর্বাপেক্ষা কাছে ছিল ইহুদিরাই। আমরা বক্ষ্যমাণ গ্রন্থের শুরুতে “ঈসায়ী ষষ্ঠ শতাব্দীতে ইহুদি ধর্ম' শিরোনামে এই সম্পর্কে মোটামুটি আলোচনা করে এসেছি।

সুতরাং ইহুদিদের থেকে তখন এই আশা করা মোটেও অযৌক্তিক ছিল না যে, তারা মুসলমানদের পক্ষে না এলেও অন্ততপক্ষে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরোধিতা করবে না। বরং এই ব্যাপারে তারা থাকবে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ। কেননা ইসলাম এসে তাদের কিতাবকে সত্যায়ন করেছে। ইসলামের নবী বনী ইসরাঈলের আম্বিয়ায়ে কিরামের প্রতি ঈমান আনার আহ্বান করেছেন। কুরআনে কারীম মুমিনদের ভাষায় ঘোষণা দিয়েছে,

كُلِّ آمَنَ بِاللَّهِ وَمَلَائِكته وكتبه وَرُسُلِهِ لَا نُفَرِّقَ بَيْنَ أَحَدٍ مِنْ رُسُلِهِ

অর্থাৎ তারা প্রত্যেকে আল্লাহ, তাঁর ফিরিশতা, তাঁর কিতাবসমূহ ও তাঁর রাসূলগণের ওপর বিশ্বাস রাখে; তারা বলে- আমরা রাসূলগণের মাঝে কোনো তারতম্য করি না। [সূরা বাকারাহ: ২৮৫]

যদি এমনই হতো- অর্থাৎ ইহুদিরা যদি মুসলমানদের ব্যাপারে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করত- তবে কেবল ইসলামের ইতিহাস নয়; বরং গোটা মানব সভ্যতার ইতিহাস ভিন্ন দিকে মোড় নিত। তাহলে ইসলাম আর মুসলমানরা সেই সকল সমস্যা আর সংকটের আবর্তে জড়িতে পড়তে হতো না; যা ইসলাম ও ইহুদিবাদের মাঝের দ্বন্দ্ব-সংঘাত উসকে দিয়েছিল। সদ্য জন্ম নেওয়া একটি নতুন ও নবীন জাতিগোষ্ঠী আর প্রতিষ্ঠিত একটি পুরনো শক্তিশালী জাতিগোষ্ঠীর মাঝের রেষ ও বিদ্বেষ ছিল যেই সমস্যার উৎসমূল ।

কিন্তু দু'টি মৌলিক কারণে ইসলাম ও মুসলমানদের ব্যাপারে ইহুদিরা নিরপেক্ষ থাকতে পারেনি। তার প্রথম কারণ তো এই যে, ইহুদি জাতির জন্মের সেই প্রথম দিন থেকেই তাদের রক্ত, প্রাণ আর আত্মার মধ্যে হিংসা, বিদ্বেষ, সংকীর্ণ মানসিকতার জীবাণু ঢুকে গিয়েছিল। দ্বিতীয়ত কুরআনে কারীম তাদের নিরপেক্ষতার দিকে কখনোই লালায়িত ছিল না। যার কারণে সে তাদের ভুলগুলো ধরিয়ে দিতে মোটেও কুণ্ঠিত ছিল না। ফলে সে ইহুদিদের ভ্রান্ত আকীদা, অধঃপতিত আখলাক, যাবতীয় কুঅভ্যাস ইত্যাদির কঠোর সমালোচনা করেছে।

সে তাদের চেপে রাখা সেই ইতিহাস দুনিয়াবাসীর সামনে তুলে ধরেছে, যেখানে সব লেখা আছে- কীভাবে তারা আম্বিয়ায়ে কিরামের সঙ্গে একের পর এক যুদ্ধ-বিগ্রহে জড়িয়ে পড়েছিল, এক পর্যায়ে কীভাবে তারা আম্বিয়ায়ে কিরামকে হত্যা পর্যন্ত করেছিল, আল্লাহর পথে কতটা ঘাড় তেড়ামী তারা করেছিল, আল্লাহর উপর তারা অপবাদ দিয়েছিল, তারা অন্যায়ভাবে মাল ভক্ষণ করত, সুদ নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও তারা গোগ্রাসে খেয়ে বেড়াত, মানুষের সম্পদ তারা অন্যায়ভাবে ভোগ করত, তারা ঘুষ খেত, তাওরাতকে তারা বিকৃত করে ফেলেছিল, পার্থিব যিন্দিগিকে তারা অতিমাত্রায় ভালোবেসে ফেলেছিল ইত্যাদি। ইহুদিবাদের এই সমস্ত গুমর কুরআনে কারীম ফাঁস করে দিয়েছিল। 

এখানে যদি রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জায়গায় অন্য কোনো রাজনৈতিক নেতাকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হতো, তবে তিনি নিশ্চিতভাবেই তৎকালীন মদীনায় বিরাজমান পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার আপ্রাণ কোশেশ করতেন। পাশাপাশি ইহুদিদের সঙ্গে তোষামোদি কিংবা তাদের সঙ্গে মুহাব্বত করতে না গেলেও নিদেনপক্ষে এমন কোনো কাজ থেকে অবশ্যই বিরত থাকতেন- যা তার প্রতি ইহুদিদের ক্রোধ উসকে দিতে পারে। কিন্তু রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে তো নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল তাঁর পয়গামকে গোটা দুনিয়াবাসীর কাছে পৌঁছে দিতে।

তাকে তাঁর নির্দেশিত বিষয় মানুষের সামনে প্রকাশ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তাকে বলা হয়েছিল হক আর বাতিলের মাঝে একটি সুস্পষ্ট সীমারেখা টেনে দিতে। তাকে ফিতনা ফাসাদের সঙ্গে তাল রেখে চলতে বারণ করে দেওয়া হয়েছিল। তাকে বলা হয়েছিল জগতের জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে গোটা মানবজাতিকে ইসলামের প্রতি আহ্বান করতে। আর সেই মানবগোষ্ঠীর মধ্যে তো ইহুদি এবং খ্রিস্টানরাও ছিল। এই দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন আল্লাহ তাআলার সম্পূর্ণ অধীনে। এই ক্ষেত্রে তাঁর মোটেও স্বাধীনতা ছিল না। যত সমস্যারই সৃষ্টি হোক, তাকে তাঁর রিসালতের যিম্মাদারি পালন করতেই হবে। তাঁর আমানত পৌঁছে দিতে হবে মানুষের দ্বারে দ্বারে। কেননা এটাই সেই নবুওতী পথ- যেই পথে তাঁর পূর্বের সমস্ত আম্বিয়ামে কিরাম হেঁটে গিয়েছেন। আর এটাই সেই স্থান- যা নবুওত ও 'সিয়াসত', আম্বিয়ায়ে কিরাম আর রাজনৈতিক নেতাদের মাঝে সুষ্পষ্ট পার্থক্যের সীমারেখা টেনে দেয়।

এই সব কারণেই ইহুদিরা ইসলাম ও মুসলমানদের ব্যাপারে নিরপেক্ষ থাকতে পারেনি। বরং তারা তাদের কঠিন দুশমনি আর প্রচণ্ড শত্রুতায় মেতে উঠেছিল। ফলে মদীনার ইহুদিবাদের পরিস্থিতি বদলে গেল। এবার তারা ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে পর্দা সরিয়ে একেবারে ময়দানে নেমে এলো। এই দ্বন্দ্ব সংঘাতের কারণ বর্ণনা করেছেন প্রখ্যাত ইহুদি লেখক ইসরাঈল ওয়েলফেনসন। তিনি এই ক্ষেত্রে কোনো পক্ষপাতিত্বের আশ্রয় না নিয়ে সততা আর আমানতদারিরই পরিচয় দিয়েছেন সুন্দরভাবে। তিনি লেখেন:

অর্থাৎ যদি রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর শিক্ষা কেবল পৌত্তলিক ধর্মের বিরোধিতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত এবং যদি ইহুদিদেরকে তার রিসালতের স্বীকৃতি না দিতে হতো, তবে ইহুদি ও মুসলমানদের মাঝে কখনোই দ্বন্দ্ব-সংঘাতে সৃষ্টি হতো না। বরং ইহুদিরা তখন সম্মান ও মর্যাদার দৃষ্টিতে ইসলামের প্রতি তাকাতো। তাকে জান-মাল দিয়ে সবরকমের সাহায্য-সহযোগিতা করত। যতক্ষণ না তিনি মূর্তি ভাঙতে এবং গোটা জাযীরাতুল আরব থেকে পৌত্তলিক ধর্মকে চিরতরে বিদায় করে দিতে সক্ষম না হন। কিন্তু কথা হলো সেই একটাই- ইহুদি ধর্মের বিরুদ্ধে তিনি কিছু বলতে পারবেন না। ইহুদিদেরকে তাঁর নবুওত ও রিসালতের স্বীকৃতি দিতে হবে না। কেননা ইহুদিদের বুদ্ধিবৃত্তি কোনোদিনও এমন কিছুকে মেনে নেয়নি- যা তাদেরকে তাদের দীন থেকে সরিয়ে দিতে পারে। একইভাবে ইহুদিরা তাদের ইতিহাসে কেবল ঐ সকল লোককেই নবী হিসেবে মেনে নিয়েছে যারা কোনো না কোনোভাবে বনী ইসরাঈলের বংশধর।

এগুলোর পাশাপাশি ইহুদিদের বেশ কিছু বড় বড় আলিম ও বিদগ্ধ মানুষের ইসলাম গ্রহণ তাদের এই ক্রোধ আর উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন সালাম রা. এর কথা উল্লেখ করা যায়। তিনি ছিলেন ইহুদিদের মাঝে বিশাল সম্মানের অধিকারী একজন মানুষ। তাই তারা এটা স্বপ্নেও কোনোদিন ভাবেনি যে, আব্দুল্লাহ বিন সালাম ইসলাম গ্রহণ করে বসবে। এটা তাদের মনের গভীরে দাফন করা হিংসা আবার জাগিয়ে তুলেছিল।

পরবর্তীতে ইহুদিরা কেবল ইসলাম ও মুসলমানদের বিরোধিতা করেই ক্ষান্ত হয়নি। বরং তারা এক সময় তাদের ঘৃণিত পৌত্তলিক ধর্মকে ইসলামের ওপর শ্রেষ্ঠ বলতে লাগল । অথচ মুসলমানরাও তাদের মতো এক খোদার স্বীকৃতি দেয় এবং মূর্তি-পূজার বিরোধিতা করে। এতটুকু হলে যুক্তি ও অনুমানের বাইরে হতো না যে, যদি তাদের কাছে পৌত্তলিকতা আর ইসলামের মাঝে শ্রেষ্ঠত্ব- অশ্রেষ্ঠত্বের কথা জিজ্ঞাসা করা হতো তবে তারা শত বিভেদ সত্ত্বেও ইসলামকে পৌত্তলিকতার চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলত। কিন্তু হিংসা ও বিদ্বেষ তাদেরকে এই সামান্য ইনসাফের জ্ঞানটুকুর কথাও ভুলিয়ে দিলো।

যার কারণে দেখা যায়, যখন মক্কার পৌত্তলিক গোষ্ঠীর লোকেরা ইহুদি আলিমদের কাছে জিজ্ঞাসা করেছিল- হে ইহুদি সম্প্রদায়! তোমরাই সর্বপ্রথম আহলে কিতাব। সঠিক ও প্রকৃত জ্ঞান তোমাদের কাছেই। আমাদের ও মুহাম্মাদের মধ্য থেকে কার ধর্ম উত্তম ? তখন তারা বলেছিল, তোমাদের ধর্ম তাঁর ধর্মের চেয়ে উত্তম। আর তোমরাই হক ও সত্যের অধিক নিকটবর্তী। ৩১৭

এই সম্পর্কে ইহুদি লেখক ইসরাঈল ওয়েলফেনসনের মূল্যায়ন

অর্থাৎ কিন্তু সত্যি সত্যিই যে কারণে ইহুদিরা নিন্দার যোগ্য, এবং যে বিষয়টি আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসী ইহুদি কিংবা মুসলমান যে কাউকেই আঘাত দিবে তা হলো, পৌত্তলিক কুরাইশ ও ইহুদিদের একটি দলের মাঝের আলোচনা। যখন ইহুদিদের সেই দলটি কুরাইশদের পৌত্তলিক ধর্মকে ইসলামের নবীর আনীত ধর্মের ওপর অগ্রাধিকার দিয়েছিল।

তিনি আরও সামনে এগিয়ে বলেন,

অর্থাৎ যদিও সামরিক যুদ্ধে শত্রুপক্ষের ওপর বিজয় লাভের জন্য প্রতারণা, ধোঁকা এবং অন্যান্য নিষিদ্ধ কর্মকাণ্ড বিভিন্ন জাতি ও ধর্মের মধ্যে বৈধ ও অনুমোদিত ছিল, তা সত্ত্বেও ইহুদিদের এই ক্ষেত্রে এতবড় একটা ভুল করা কোনোদিনও উচিত হয়নি। তাদের ঠিক হয়নি কুরাইশের নেতাদের সামনে একেবারে স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা দিয়ে দেওয়া যে, ইসলামের একত্ববাদের চেয়ে তাদের পৌত্তলিকবাদ উত্তম।

যদিও এর মাধ্যমে তাদের কাঙ্খিত লক্ষ্য-উদ্দেশ্য থেকে বঞ্চিত হতো তারপরেও। কেননা বনী ইসরাঈল যারা হাজার হাজার বছর ধরে তাদের পূর্বপুরুষদের নাম ধরে পৌত্তলিক জাতিগোষ্ঠীর মাঝে তাওহীদের পতাকা উঁচু করে ধরে রেখেছিল, পাশাপাশি যারা ইতিহাসের বিভিন্ন ধাপে ধাপে তাওহীদের জন্য এতটা যুলুম-নির্যাতন, আগুন, রক্তপাত সহ্য করেছে, অন্য কারও বেলায় তেমন ইতিহাস নেই। আর তাই তাদের কর্তব্য ছিল মুশরিকদেরকে লাঞ্ছিত করার জন্য প্রয়োজন হলে নিজের জীবন ও মুহাব্বতের সবকিছুকে বিসর্জন দিলেও দিতে হবে।

এই দিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে আল্লাহ তাআলর বাণী:

ألم تر إلَى الَّذِينَ أُوتُوا نصيبا من الكتاب يُؤْمِنُونَ بِالْجَبْتَ وَالطَّاغُوتِ وَيَقُولُونَ

للَّذِينَ كَفَرُوا هؤلاء أَهْدَى مِنَ الَّذِينَ آمَنُوا سَبِيلًا

অর্থাৎ তুমি কি তাদেরকে দেখনি, যারা কিতাবের কিছু অংশ প্রাপ্ত হয়েছে, যারা মান্য করে প্রতিমা ও শয়তানকে এবং কাফেরদেরকে বলে যে, এরা মুসলমানদের তুলনায় অধিকতর সরল সঠিক পথে রয়েছে। [সূরা নিসা: ৫১)

 

হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর জিহাদী জীবন

 


No comments yet


Leave a comment

 


Name *:



Design theme color

Primary color


Alternative color