চুল পড়ার কারণ ও চুলের নানা কথা - Causes of hair fall
06:26:47 12/10/2023
চুল পড়ার কারণ ও চুলের নানা কথা : চুল দেহত্বকের অংশবিশেষ। মায়ের গর্ভে ভ্রূণের বয়স যখন মাত্র তিন সপ্তাহ তখন তার ত্বকের বাইরের অংশ এপিডারমিসে কিছু কোষ একত্রিত হতে থাকে। এ কোষগুলো হলো হেয়ার ফলিকল বা চুলের কুঁড়ি। এরা ত্বকের ভেতরের স্তর ডারমিসে আশ্রয় নেয়। এখান থেকেই শুরু হয় চুল তৈরির কাজ। কাজেই মায়ের গর্ভে তিন থেকে চার সপ্তাহের মধ্যেই চুল উৎপাদন শুরু হয়ে যায়। ছত্রিশ থেকে চল্লিশ সপ্তাহের মধ্যে স্বাভাবিক চুল তৈরি হয়।
চুলের মূল বা রুট থাকে ত্বকের নিচের কেশকূপ বা হেয়ার ফলিকলে। চুলের কাণ্ড বা শ্যাফটস থাকে বাইরে। এ অংশটিকেই আমরা বাইরে থেকে দেখি। চুলের বাইরের আবরণের নাম কিউটিকল, ভেতরে থাকে কর্টেক্স, আর একদম ভেতরে মেডুলা। মাথার চুলে কিন্তু মেডুলা থাকে না।
কর্টেক্সে থাকে রঞ্জক পদার্থ মেলানিন, যার পরিমাণের ওপর চুল কতটা কালো হবে তা নির্ভর করে। চুলের গোড়া বা হেয়ার ফলিকলের নিচে থাকে কিছু সজীব কোষ বা হেয়ার ম্যাট্রিক্স। এ ম্যাট্রিক্সকে আবার নিয়ন্ত্রণ করে বংশগতি ও নানা ধরনের হরমোন। চুলে কিন্তু কোনো রক্তনালী নেই । চুলের পুষ্টি আসে ত্বকের পুষ্টি থেকে।
শুধু সৌন্দর্যবৃদ্ধি নয়, নানা কাজ করে আমাদের চুল। দেহের বাইরের তাপমাত্রার তারতম্য নিয়ন্ত্রণ করে। রোদের তাপ ও নানা ক্ষতিকর বিকিরণ থেকে দেহকে রক্ষা করে। রোগজীবাণুর আক্রমণ এবং ধোঁয়া, ধুলোর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা করে দেহের বিভিন্ন অংশের চুল।
প্রতিদিন আমাদের ৩০ থেকে ১০০টা চুল পড়ে। চুলের একটি নির্দিষ্ট জীবনচক্র আছে। জন্মানোর পর থেকে বছরে ৩/৪ বার বাড় বাড়ন্ত অবস্থা, যাকে বলে অ্যানাজেন পর্ব। এরপর সপ্তাহ তিনেক ধরে বুড়িয়ে যাওয়ার পর্ব। একে বলে ক্যাটাজেন পর্ব। শেষপর্বটি ৩/৪ মাস ধরে বিশ্রাম পর্ব, যাকে বলে টেলোজেন পর্ব।
এ সময় পুরনো চুল নড়বড়ে হতে থাকে। নতুন চুল যা ধীরে ধীরে ম্যাট্রিক্সে বেড়ে উঠছিল, একদিন হঠাৎ মাথা উঁচু হয়ে দাঁড়ায়। সুতরাং সবার চুল পড়ে। মাথার এক লাখ চুলের মাঝে একশটা পড়ে গেলে কোনো সমস্যা নেই। তবে গোছা গোছা চুল পড়লে তা অবশ্যই সমস্যার কথা।
চুল পড়ার কারণ
চুল নানা কারণে পড়ে । প্রাকৃতিক কারণে চুল কমতে শুরু করে। ত্রিশ বছরের মধ্যেই চুলের ঘনত্ব প্রতি বর্গমিটারে ৬১৫ থেকে কমে ৪৮৬ তে দাঁড়ায়। আরো বয়স বাড়লে ৪৩০ হয়।
পুরুষ হরমোন অ্যান্ড্রোজেন চুল পড়ার জন্য দায়ী। পুরুষদের এই হরমোনের কারণে চুল পড়ে থাকে। একে অ্যান্ড্রোজেনিক এলোপিসিয়া বলে। বংশানুক্রমে কোনো পরিবারে এ হরমোনের প্রতি হেয়ার ফলিকলের সংবেদনশীলতা বেশি থাকলে সেই বংশে টাক পড়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
বাচ্চা হওয়ার পর ৩-৪ মাস মায়েদের খুব চুল পড়তে থাকে। এর কারণ ইস্ট্রোজেন হরমোন। এ হরমোন গর্ভাবস্থায় হেয়ার ফলিকলের কাজ কমিয়ে দেয়। ফলে অ্যানাজেন থেকে ক্যাটাজেন হয়ে টেলোজেন পর্বে পৌঁছাতে দেরি হয়। আবার টেলোজেন পর্বে পৌঁছে গেলে তাকে পড়তেও বাধা দেয় ইস্ট্রোজেন। এক লাখ চুলের মাঝে মাত্র পনেরো শতাংশ টেলোজেন কুঁড়ি পাওয়া যায় স্বাভাবিক অবস্থায়। অথচ গর্ভাবস্থার শেষে বেশি পরিমাণ ইস্ট্রোজেন হরমোন এটাকে ৫ শতাংশে পরিণত করে। এভাবে গর্ভাবস্থায় চুল কম পড়ে। কিন্তু বাচ্চা হওয়ার পরে ইস্ট্রোজেন হরমোন কমে যাওয়ায় পুরো উল্টো ব্যাপার ঘটতে থাকে। গোছা গোছা চুল পড়ে। তবে ঘাবড়াবার কিছু নেই। ৩ থেকে ৪ মাসের মাঝে ব্যাপারটা আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে।
দেহের পুষ্টি থেকে ত্বক এবং চুলের পুষ্টি হয়। বাইরে থেকে এটা সেটা মেখে চুলের পুষ্টি হয় না একথা মনে রাখবেন। মাথার ত্বকের ডারমিসে যে হেয়ার ফলিকল থাকে সেখানে অসংখ্য রক্তবাহী নালিকা থাকে। আর এরা চুলের জন্য পুষ্টি বহন করে আনে হেয়ার ফলিকলে। চুলের পুষ্টি আসে আমরা যা খাই তা থেকে। রোজ সুষম খাদ্য খাওয়া প্রয়োজন । প্রতিদিন ৩০০ গ্রাম শর্করা, ৭০ গ্রাম প্রোটিন, ৩৩ গ্রাম ফ্যাট এবং ৬-৭ গ্লাস পানি দেহের জন্য প্রয়োজন। এছাড়া নানা খনিজ পদার্থ যেমন- আয়রন অত্যন্ত প্রয়োজন। নারীদের অ্যানিমিয়ার কারণে চুল পড়ে। তাই আয়রনসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করা দরকার। মানসিক চাপ, অতিরিক্ত ডায়েটিং কিংবা কোনো অসুখের কারণেও চুল পড়তে পারে। এক্ষেত্রে অসুখের চিকিৎসা করলে চুল পড়া বন্ধ হবে বলে আশা করা যায়।
দেহে থাইরয়েড হরমোনের তারতম্যের জন্য চুল পড়তে পারে। এ ধরনের রোগে শুধু চুল পড়ে যায় তা নয়, বাকি চুল শুকনো ও ঔজ্জ্বল্যহীন হয়ে পড়ে।
কিছু ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার কারণে চুল পড়তে পারে। কেমোথেরাপির কারণে গোছা গোছা চুল পড়ে। এছাড়া অনেক ওষুধ দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে চুল পড়তে পারে। দীর্ঘস্থায়ী কোনো রোগ শরীরে বাসা বাঁধলে তার কারণে চুল পড়তে পারে। যেমন— পেটের অসুখ, অ্যানিমিয়া, ক্যান্সার ইত্যাদি ।
অনেক সময় গোল হয়ে মাথার শুধু এক অংশের চুল পুরোটা উঠে যেতে পারে, একে এলোপিসিরা এরিয়েটা বলে। অটোইমিউন ডিসঅর্ডার হলে এমনটা হতে পারে। অনেক সময় পুরো মাথা বা সারা শরীরের চুলও পড়ে যেতে পারে, একে এলিপিসিয়া টোটালিস ও এলিপিসিয়া ইউনিভার্সালিস বলে।
মাথার ত্বকে নানা রোগের সংক্রমণেও চুল পড়তে পারে। খুশকি, সেবোরিক ডার্মাটাইটিসসহ নানা প্রদাহে চুল পড়তে পারে। এছাড়া তেল, শ্যাম্পু কিংবা কলপের কেমিক্যালের জন্যও চুল পড়তে পারে। এছাড়া আধুনিককালে আমরা চুল পামিং, কার্লিং, স্ট্রেইটেনিং করি। এতে চুলের ক্ষতি হয়।
চুল পড়ার চিকিৎসা
প্রথমে চুল কেন পড়ছে কিংবা আদৌ অস্বাভাবিকভাবে পড়ছে কিনা তা নির্ণয় করা প্রয়োজন। কেননা চিকিৎসা হওয়া উচিত কারণ অনুযায়ী। এর তার কথায় এটা সেটা না মেখে ত্বক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়া অত্যন্ত জরুরি। আর ধৈর্য ধরে চিকিৎসা নিতে হবে।
কারণ অনুযায়ী চিকিৎসার কথা আগেই বলা হয়েছে, তবে পুষ্টির ব্যাপারটা লক্ষ্য রাখাটাও জরুরি।
পুষ্টিকর খাবার বিশেষ করে ফল ও শাকসবজি খাওয়া প্রয়োজন। ভিটামিন ই, জিঙ্ক, আয়রন, ক্যালসিয়াম ইত্যাদি ট্যাবলেট চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী খাওয়া যেতে পারে। মিনিক্সিডিল নামে একটি ওষুধ আজকাল টাকে চুল গজাবার জন্য ব্যবহার হচ্ছে। যদিও এটি রক্তচাপ কমানোর ওষুধ। এছাড়া ফিনাস্টেরাইড নামের আরেকটি ওষুধও ব্যবহার হচ্ছে। ফিনাস্টেরাইড পুরুষদের প্রস্টেটের বৃদ্ধি রোধে ব্যবহার হয়। এসব ওষুধ অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ব্যবহার করতে হবে।
হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট টাক সমস্যার সমাধান এনেছে। এছাড়া সক্যালন্স রিডাকশন রোটেশন ফ্ল্যাপসহ নানা পদ্ধতিতে টাক ঢাকা হচ্ছে। মাইক্রোগ্রাফটও বেশ কাজ দেয়।
যে কারণেই টাক পড়ুক না কেন যদি হেয়ার ফলিকল জীবিত থাকে তবে আবার চুল গজাবে। আর হেয়ার ফলিকল না থাকলে কোনো ওষুধেই চুল গজাবে না এবং তখন উপায় হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট। এছাড়া মাইক্রোগ্রাফটও করা যায়। এসবের ফলাফল যথেষ্ট আশাব্যাঞ্জক কিন্তু চুলের ধরন, চরিত্র এবং সার্জনের দক্ষতা এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ।
চুল প্রকৃতির সেই উপহার, যা আমাদের মুখের সৌন্দর্য বাড়ায়। চুল পড়াটাকে সমস্যা মনে না করে, নিরাশ না হয়ে এর সমাধানে সচেতন হওয়া প্রয়োজন ।
● হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর জিহাদী জীবন