রাসূলের দূত হত্যা ও তার শাস্তি - Dut Hotta
03:36:20 12/10/2023
রাসূলের দূত হত্যা ও তার শাস্তি : রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রোম সম্রাটের পক্ষ থেকে বুসরার গভর্নর শুরাহবীল ইবনে আমর গাসানী বরাবর পত্র দিয়ে প্রেরণ করেছিলেন সাহাবী হারিস ইবনে উমাইর আযদী রা. কে। শুরাহবীল তাকে প্রথমে বেঁধে রাখলো 'অতঃপর তরবারি দিয়ে তার ঘাড় উড়িয়ে দিলো। ২৪৫ দূত যত মারাত্মক সংবাদই বহন করে নিয়ে যাক না কেন- পৃথিবীর রাজা-বাদশাহ ও সম্রাটদের কখনোই দৃত হত্যার নীতি ছিল না।
বস্তুত এটা ছিল এমন একটি অপরাধ যার শাস্তি না দিয়ে পারা যায় না। কারণ এটা গোটা পৃথিবীর সমস্ত দূত ও পত্রবাহককে চরম বিপদ আর শঙ্কার অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছিল। পাশাপাশি পত্র প্রেরক ও তার প্রেরিত বার্তার বিরুদ্ধেও এটা ছিল একটা চরম বেয়াদবী। আর তাই এই বেয়াদবকে শিক্ষা দেওয়াটা তখন জরুরি হয়ে পড়েছিল। যাতে করে ভবিষ্যতে পত্রবাহকদের জীবনে আর কোনোদিন এমন সর্বনাশ নেমে না আসে। পাশাপাশি এই ধরনের দুঃখজনক ট্র্যাজিডির আর যেন পুনর্বায়ন না হয় ।
রোমের মাটিতে সর্বপ্রথম মুসলিম বাহিনী
রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে এই দুঃখজনক সংবাদ পৌছা মাত্রই তিনি বুসরার দিকে একটি বাহিনী পাঠানোর মনোস্থ করলেন। এটা ছিল হিজরতের অষ্টম বর্ষের জুমাদাল উলা মাসের ঘটনা। সাহাবায়ে কিরাম প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন। তাদের সংখ্যা ছিল তিন হাজার। তাদের আমীর হিসেবে নির্ধারণ করলেন তাঁর গোলাম যায়দ বিন হারেসা রা. কে। অথচ সেই বাহিনীতে বড় বড় মুহাজির ও আনসার সাহাবায়ে কিরাম শরীক হয়েছিলেন।
রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলে দিলেন- যদি যায়দ বিন হারেসা শহীদ হয়ে যায়, তবে জাফর বিন আবু তালিব আমীর হবে। আর যদি জাফর বিন আবু তালিব রা. শহীদ হয়ে যায় তবে আব্দুল্লাহ বিন রওয়াহা আমীর হবে। যখন তাদের যাত্রার সময় হলো, লোকেরা এসে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আমীরগণকে বিদায় সালাম জানালেন।"" আর তাদের সামনে ছিল কষ্টসংকুল একটি প্রলম্বিত সুদীর্ঘ পথ। তৎকালীন সর্বাধুনিক সমরাস্ত্রে সুসজ্জিত দৈত্যকায় দুশমনের বিশাল বাহিনী।
মুসলিম বাহিনী মদীনা থেকে বের হয়ে মাআন নামক স্থানে এসে যাত্রাবিরতি দিলো। সেখানে তাদের কাছে এসে সংবাদ পৌঁছল যে, এক লক্ষ রোমান সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে সম্রাট হিরাক্লিয়াস বলকাতে রয়েছেন। তাছাড়া লখম, জুযাম, বলকাইন, বাহরা, বালী ইত্যাদি আরব কবীলার অসংখ্য সৈন্যও তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। তখন মুসলিম বাহিনী পরামর্শের মধ্য দিয়ে মাআনেই দুদিন কাটিয়ে দিলেন। পরিশেষে তারা সিদ্ধান্ত নিলেন- আমরা রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে পত্র লিখে পুরো ব্যাপারটি জানিয়ে দিব। হয়তো তিনি আমাদেরকে আরও সৈন্য দিবেন নয়তো আমাদেরকে আগে বাড়ার নির্দেশ দিবেন। তখন আমরা সেই অনুযায়ী কাজ করব।"
আমরা জনবল কিংবা অস্ত্রবলে যুদ্ধ করি না
তখন আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা রা. লোকদেরকে জিহাদের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে তুললেন। তিনি বললেন, হে আমার কওম! তোমরা কি এখন সেই জিনিসকে অপছন্দ করছ যার তালাশেই তোমরা বের হয়েছো ? তোমরা কি শাহাদত চাচ্ছো না? মনে রেখো- আমরা তো অস্ত্রবল কিংবা জনবলের দোহাই দিয়ে যুদ্ধ করি না। বরং আমরা যুদ্ধ করি এই দীন দিয়ে আল্লাহ তাআলা যার দ্বারা আমাদেরকে ইয্যত দিয়েছেন। তাই তোমরা সামনের দিকে বাড়ো। তাতে দুই ভালোর একটাতো অর্জিত হবেই। মরলে শহীদ, আর বাঁচলে গাজী। তখন মুসলিম বাহিনী আবার সামনে এগিয়ে চলল। "
সিংহের গর্জন
যখন মুসলিম বাহিনী বলকার কাছাকাছি পৌঁছল, তখন তারা জানতে পারল যে, রোমান ও আরব সৈন্যরা বলকার মাশারিফ নামক একটি গ্রামে অবতরণ করেছে। মুসলমানদের আগমনের সংবাদ পেয়ে শত্রুবাহিনী সামনে অগ্রসর হলো। মুসলমানরা তখন মৃতা নামক একটি গ্রামে নিজেদের অবস্থান নিলেন। বস্তুত এখানেই সংঘটিত হয়েছিল সেই ঐতিহাসিক যুদ্ধ।
যায়দ বিন হারেসা রা. রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বেঁধে দেওয়া পতাকা নিয়ে যুদ্ধ করতে করতে এক পর্যায়ে শাহাদাতের পিয়ালায় ঠোঁট লাগালেন। বর্ণা তার শরীর চালনির মতো ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে জাফর বিন আবী তালিব রা. রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পতাকা হাতে তুলে নিলেন এবং যুদ্ধ চালিয়ে যেতে লাগলেন। যুদ্ধ যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছল তখন তিনি ঘোড়া থেকে লাফ দিয়ে নীচে নেমে ঘোড়ার পা কেটে দিয়ে আবার মাটিতেই যুদ্ধ চালিয়ে যেতে লাগলেন।
এক পর্যায়ে তার ডান হাত কেটে গেল। তিনি বাম হাত দিয়ে পতাকা উঁচু করে ধরলেন। এক পর্যায়ে তার বাম হাত কেটে গেল। এবার তিনি দুই বাহু দিয়ে পতাকা উঁচু করে ধরলেন। পরিশেষে এক পর্যায়ে তিনি শহীদ হয়ে জান্নাতের পথ ধরলেন। তখন তার বয়স হয়েছিল মাত্র তেত্রিশ বছর। মুসলমানরা পরবর্তীতে তাঁর বুক, কাঁধ ও অন্যান্য জায়গায় সর্বমোট নব্বইটি আঘাত লক্ষ করেছিলেন। তার কোনোটি ছিল তরবারির, কোনোটি ছিল বর্শার। বাকি সবগুলো ছিল সামনের দিক দিয়ে। ১ এর দ্বারা বোঝা যায়- তিনি পেছনে সরে যাওয়ার আদৌ কোনো চিন্তাই করেননি।
এভাবে তিনি শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করলেন। বস্তুত জীবন ও যিন্দিগির প্রতি তিনি মোটেও লালায়িত ছিলেন না। তিনি লালায়িত ছিলেন এই শাহাদাতের প্রতি। পরিশেষে তার মনের তামান্না পূর্ণ হলো। শত্রু আর দুনিয়ার সৌন্দর্যের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে সর্বোত্তম বন্ধুর পথে সান্ত জীবন বিলিয়ে দিয়ে এক অনন্ত জীবনের পথে যাত্রা করলেন।
জাফর রা. শহীদ হয়ে গেলে আব্দুল্লাহ ইবনে রওয়াহা রা. সামনে অগ্রসর হয়ে পতাকা হাতে তুলে নিলেন। তিনি তার ঘোড়া থেকে মাটিতে অবতরণ করলেন। তখন তার এক চাচাতো ভাই একখানি গোশতওয়ালা হাড় নিয়ে এসে বলল, এর দ্বারা একটু শক্তি সঞ্চয় করুন। এতদিন আপনি প্রচুর কষ্ট করেছেন। তখন তিনি সেটা হাতে নিলেন এবং অল্প একটু খেলেন। অতঃপর সেটা ফেলে দিয়ে হাতে তরবারি উঠিয়ে নিয়ে যুদ্ধের মধ্য ঢুকে গেলেন। এবং শাহাদাত বরণ করলেন।
●হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর জিহাদী জীবন