মদীনায় হিজরতের অনুমতি - Permission to migrate to Medina
03:30:12 12/11/2023
মদীনায় হিজরতের অনুমতি : যখন মদীনার আনসারদের এই দলটি রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে সাহায্য সহযোগিতা আর নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিলো, তখন বেশ কিছু মুসলমান হিজরত করে তাদের কাছে গিয়ে আশ্রয় নিলেন। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কিরাম ও মক্কার অন্যান্য মুসলমানকে মদীনায় হিজরতের নির্দেশ দিলেন। তিনি বললেন- আল্লাহ তাআলা তোমাদের জন্য এমন একটি ভ্রাতৃগোষ্ঠী আর ভূখণ্ড তৈরি করে দিয়েছেন যেখানে গিয়ে তোমরা নিরাপত্তা পাবে। তখন সাহাবায়ে কিরাম রা. দলে দলে হিজরত করতে লাগলেন। অপরদিকে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর পক্ষ থেকে হিজরতের অনুমতির অপেক্ষায় মক্কায় অবস্থান করতে লাগলেন।
তবে মক্কা থেকে মুসলমানদের এই হিজরত কিন্তু একেবারে পানির মতো সহজ ছিল না যে, কুরাইশরা এটা শুনবে আর তারপরেও তারা হাত গুটিয়ে মুসলমানদেরকে তাদের সামনে দিয়ে আসতে দিবে। বরং তারা মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের পথে বড় বড় বাধার প্রাচীর দাঁড় করিয়ে দিত। বিভিন্নভাবে মুহাজিরদেরকে কষ্ট দিত। তবে মুহাজির সাহাবায়ে কিরাম এর কোনো পরওয়া করতেন না। মক্কায় আর বসবাস করাকে তারা কখনোই অগ্রাধিকার দিতেন না। চাই তাতে যত বাধাই তাদের সামনে আসুক না কেন। কখনো কখনো তাই দেখা যেত, কেউ নিজ স্ত্রী ও পুত্রকে মক্কায় রেখেই হিজরত করে মদীনায় চলে গিয়েছিলেন। যেমন করেছিলেন আবু সালামা রা.। আবার কেউ কেউ নিজের জীবনের অর্জিত সবকিছু দুশমনদের হাতে তুলে দিয়ে মদীনায় হাযির হয়েছিলেন। যেমন করেছিলেন সুহাইব রা.।
উম্মে সালামা রা. বলেন, যখন আবু সালামা মদীনায় হিজরতের জন্য প্রস্তুত হলেন তখন আমার জন্য তার উটকে প্রস্তুত করলেন। অতঃপর আমাকে উটের ওপর উঠিয়ে আমার বাচ্চা সালামা ইবনে আবী সালামাকে আমার কোলে দিলেন। অতঃপর তিনি নিজে উটের লাগাম ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলেন। যখন বনু মুগীরার লোকেরা তাকে দেখল, তখন তারা তাকে জিজ্ঞাসা করল- তোমার নফস তোমার ওপর বিজয় লাভ করেছে, তাতে আমাদের সমস্যা নেই। কিন্তু তোমার স্ত্রী আমাদের মেয়ে। তাকে আমরা কীসের ওপর ভিত্তি করে তোমার হাতে সেই দূর দেশে ছেড়ে দিব? উম্মে সালাম রা. বলেন, অতঃপর তারা আবু সালামার হাত থেকে উটের রশি ছিনিয়ে নিলো এবং আমাকে তার কাছ থেকে জোর করে নিয়ে গেল।
উম্মো সালামা রা. বলেন- এই সংবাদ পেয়ে আবু সালামার কওম বনু আব্দুল আসাদ উত্তেজিত হয়ে উঠল। তারা বলল, তোমরা যখন আমাদের ছেলের কাছ থেকে তোমাদের মেয়েকে ছিনিয়ে নিয়েছি- খোদার কসম! আমরা আমাদের ছেলেকে তোমাদের কাছে রাখতে পারি না। এরপর তারা আমার ছেলেকে নিয়ে টানাটানি শুরু করল। এক পর্যায়ে বনু আব্দুল আসাদ সালামাকে আমার হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে গেল। আর বন্ধু মুগীরা আমাকে তাদের কওমের ভেতরে নিয়ে গেল । আর আমার স্বামী আবু সালামা মদীনার পথে চলে গেলেন। এভাবে আমরা তিনজনই আলাদা হয়ে পড়লাম। তারপর থেকে প্রতিদিন প্রত্যুষে আমি আবতাহ নামক স্থানে গিয়ে বসে থাকতাম। সারাদিন সেখানে কেঁদে কেঁদে সন্ধ্যা করতাম। এভাবে কেটে গেল প্রায় একটি বছর। অতঃপর একদিন আমার এক আত্মীয় আমার অবস্থা দেখলেন।
তার হৃদয়ে আমার প্রতি বড় করুণা হলো। তিনি গিয়ে বনু মুগীরাকে বললেন- তোমরা এই মিসকীন নারীকে কেন যেতে দিচ্ছ না? তোমরা তার স্বামী আর সন্তানের মাঝে বিচ্ছেদ ঘটিয়েছ। তখন তারা আমাকে বলল- মন চাইলে স্বামীর কাছে চলে যেতে পারো। তখন বনু আব্দুল আসাদ আমার ছেলেকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিলো। আমি আমার উট প্রস্তুত করলাম। অতঃপর ছেলেকে কোলে নিয়ে মদীনার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম। আল্লাহর গোটা সৃষ্টিজগতের একটি প্রাণী আমার সঙ্গে ছিল না। যখন আমি 'তানঈম' গিয়ে পৌঁছলাম, সেখানে বনু আব্দুদ্দারের উসমান ইবনে তালহা ইবনে আবী তালহার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হলো। তিনি আমাকে বললেন, হে আবু উমাইয়্যার মেয়ে! আপনি কোথায় যাচ্ছেন? আমি বললাম- মদীনায়। তিনি বললেন- আপনার সঙ্গে কি আর কেউ নেই? আমি বললাম- এক আল্লাহ আর আমার এই বাচ্চা ছাড়া আর কেউ আমার সঙ্গে নেই।
তখন তিনি বললেন- খোদার কসম! আপনার গন্তব্যে পৌঁছা এত সহজ নয়। অতঃপর তিনি আমার উটের লাগাম ধরে সামনে থেকে টেনে নিয়ে যেতে লাগলেন। খোদার কসম! আমি আমার জীবনেও তার চেয়ে অধিক ভদ্র আর সম্ভ্রান্ত কোনো মানুষ দেখিনি । আমরা যখনই কোথাও যাত্রাবিরতি করতাম, তিনি উটকে বসিয়ে আমার কাছ থেকে পেছনে সরে যেতেন। অতঃপর আমি উট থেকে নামলে তিনি উটকে সরিয়ে নিয়ে তার থেকে সামান নামিয়ে নিতেন। অতঃপর সেটাকে কোথাও বেঁধে দূরে কোনো গাছের নীচে বিশ্রাম নিতেন। এরপর যাত্রার সময় হলে, আবার উটকে দাঁড় করিয়ে আমার দিকে এগিয়ে দিতেন।
সেটাকে প্রস্তুত করে তিনি সরে যেতেন এবং বলতেন- আপনি আরোহণ করুন। যখন আমি ঠিকমতো আরোহণ করতাম তিনি উটের লাগাম ধরে সামনে থেকে আবার টানতে শুরু করতেন। এভাবে করতে করতে একসময় আমরা মদীনায় পৌঁছে গেলাম। যখন তিনি সেখান থেকে বনু আমর বিন আউফের মহল্লা 'কুবা' দেখতে পেলেন, তখন তিনি বলে উঠলেন- আপনার স্বামী এই শহরেই আছেন । আল্লাহ তাআলার বরকতসহ আপনি সেখানে দাখিল হোন। অতঃপর তিনি মক্কায় ফিরে গেলেন। উম্মে সালামা পরবর্তী সময়ে বলতেন- ইসলামে আমার এমন কোনো পরিবারের কথা জানা নেই, আবু সালামার পরিবারের মতো যারা এতটা বিপদে পড়েছিল। আর আমি আমার জীবনেও এমন কোনো সঙ্গী দেখিনি, যিনি উসমান ইবনে তালহার চেয়ে অধিক সম্ভ্রান্ত আর সৎ ছিলেন।
একইভাবে সুহাইব রা. হিজরতের ইরাদা করলে কুরাইশ কাফেররা তাকে বলল, তুমি এক কপর্দকশূন্য তুচছ গোলাম হয়ে এখানে এসেছিলে। আর আজকে তোমার আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছে। আবার এখন সবকিছু নিয়ে এখান থেকে চলে যাচ্ছো। খোদার কসম! এটা কখনোই হতে পারে না। সুহাইব তাদেরকে বললেন- যদি তোমাদেরকে আমি আমার যাবতীয় ধন- সম্পদ দিয়ে দিই, তবে কি তোমরা আমার পথ ছেড়ে দিবে? তারা বলল, হাঁ দিব।
সুহাইব বললেন- তবে আমার সমস্ত ধন-সম্পদ তোমাদের। যখন রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই সংবাদ পেলেন তখন বললেন- সুহাইব ব্যবসায় লাভবান হয়েছে। সুহাইব ব্যবসায় লাভবান হয়েছে। উমর বিন খাত্তাব রা., তালহা রা, হামযা রা, যায়দ বিন হারিসা রা., আব্দুর রহমান বিন আউফ রা., যুবাইর ইবনুল আওয়্যাম রা., আবু হুযাইফা রা., উসমান বিন আফফান রা. সহ অন্যান্য সকল সাহাবায়ে কিরাম হিজরত করে মদীনায় চলে গেলেন। শেষপর্যন্ত মক্কাতে কেবল দুর্বল, বৃদ্ধ ও কুরাইশদের বাধার মুখে পড়ে হিজরত করতে অক্ষম সাহাবী ব্যতীত মক্কায় আর কেউ বাকি রইলেন না। আলী রা. ও আবু বকর রা. রইলেন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নির্দেশের অপেক্ষায়।
●হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর জিহাদী জীবন