Narrow selection

​​​​​​​মদীনায় মুনাফিকদের আত্মপ্রকাশ - The debut of the hypocrites in Medina


06:17:21 12/10/2023

মদীনায় মুনাফিকদের আত্মপ্রকাশ : রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মক্কী যিন্দিগিতে নিফাকী ও মুনাফিক বলতে কিছু ছিল না। ১২ কেননা ইসলাম সেখানে বিজয়ী শক্তি ছিল না। সেখানে তার কোনো ক্ষমতা ছিল না। সেখানে কারও কোনো কল্যাণ-অকল্যাণ, ভালো-মন্দ তার হাতে ছিল না। বরং যে ব্যক্তিই এই ইসলামে দাখিল হতো, তার জান-মাল প্রচণ্ড হুমকির মধ্যে পড়ে যেত। ইসলামের দুশমনরা তার বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে যেত। সব ধরনের অত্যাচার আর নির্যাতনের সম্মুখীন হতে হতো তাকে।

আর তাই ইসলামে কেবল সেই সকল পুণ্যাত্মাই দাখিল হতেন, ঈমানের জন্য যারা নিজেদের জান বাজি রাখতে রাজি ছিলেন। নিজের ভবিষ্যৎ যিন্দিগির অস্তিত্ব যারা কেবল সেই ঈমান আর বিশ্বাসের মাঝেই দেখতে পেতেন। মুশরিকরা সেখানে ছিল শক্তিশালী। আর তাদের বিপরীতে মুমিনরা ছিল দুর্বল। কুরআনের বর্ণিল বর্ণনা শুনুন:

وَاذْكُرُوا إِذْ أَنتُمْ قَلِيلٌ مُسْتَضْعَفُونَ فِي الْأَرْضِ تَخَافُونَ أَنْ يَتَخَطَّفَكُمُ النَّاسُ

অর্থাৎ আর স্মরণ কর, যখন তোমরা ছিলে অল্প, পরাজিত অবস্থায় পড়েছিলে দেশে; ভীত-সন্ত্রস্ত্র ছিলে যে, তোমাদের না অন্যেরা ছোঁ মেরে নিয়ে যায়। [সূরা আনফাল: ২৬ |

অতঃপর রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা থেকে মদীনায় চলে গেলেন। তখন ইসলামের মারকাযও মক্কা থেকে মদীনায়। স্থানান্তরিত হলো। সেখানে ইসলাম বিজয়ী শক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করল। মুসলমানরাই হলেন সেখানকার শক্তিশালী দল। মদীনায় সবদিক থেকে পূর্ণ একটি ইসলামী সমাজ গড়ে উঠল। একটি নয়া বিপ্লবের বীজ মদীনার মাটিতে ধীরে ধীরে সুবিশাল মহীরূহ হিসেবে বেড়ে উঠতে লাগল। ফলে সেখানকার পরিস্থিতি ছিল মক্কার চেয়ে ভিন্ন। সেখানে কেউ ঈমান আনলে নির্যাতিত হতে হতো না। আর তাই সেখানে নিফাকির আত্মপ্রকাশ ঘটল।

সত্যি কথা কি- দুনিয়ার যেখানেই এক জায়গায় দু'টি পরস্পরবিরোধী শক্তির আত্মপ্রকাশ ঘটে, যেখানে ভিন্নধর্মী ও ভিন্নমুখী দু'টি দল, মত কিংবা বিশ্বাস বা দর্শন থাকে- সেখানেই এমন এক শ্রেণীর মুনাফিক লোক পাওয়া যাবে। এই সকল লোক থাকবে সেই পরস্পরবিরোধী দু'টি গোষ্ঠীর মাঝখানে। তারা থাকবে অস্থির, বেচাইন, ও কর্তব্য সম্পর্কে অসচেতন। তারা কখনো এদিকে দৌড়ে আসবে। তাদের জন্য ভালোবাসা আর মুহাব্বত প্রকাশ করবে। কিন্তু স্বার্থের কারণে তারা তাদের অবস্থান পূর্ণরূপে কোথাও নিশ্চিত করবে না। প্রয়োজন হলে প্রথম দল থেকে সম্পর্ক কেটে দিয়ে দ্বিতীয় দলে তরী ভিড়াতে মোটেও দ্বিধাবোধ করবে না। দেখুন- কুরআনে কারীম তাদেই এই বেচাইনী মনোভাবের কী সুন্দর চিত্রই না এঁকেছে:

ومِنَ النَّاسِ مَنْ يَعْبُدُ الله عَلى حَرْف فَإِنْ أَصَابَهُ خَيْرٌ اطْمَان به وَإِنْ أَصَابَتْهُ فِتْنَةٌ

القلب على وجهه خسر الدنيا والآخرة ذلك هُوَ الْخُسْرَانُ الْمُبِينُ

অর্থাৎ মানুষের মধ্যে কেউ কেউ দ্বিধা-দ্বন্দ্বে জড়িত হয়ে আল্লাহর ইবাদত করে। যদি সে কল্যাণপ্রাপ্ত হয়, তবে ইবাদতের উপর কায়েম থাকে এবং যদি কোন পরীক্ষায় পড়ে, তবে পূর্বাবস্থায় ফিরে যায়। সে ইহকালে ও পরকালে ক্ষতিগ্রস্ত। এটাই প্রকাশ্য ক্ষতি | সূরা হজ্জ: ১১]

তাদের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলার আরও ইরশাদ:

অর্থাৎ এরা দোদুল্যমান অবস্থায় ঝুলন্ত; এদিকেও নয় ওদিকেও নয়। [সূরা নিসা: ১৪৩]

মদীনার এই সকল মুনাফিক লোকের রঈস আর সরদার ছিল আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সাল। ইতঃপূর্বে মদীনায় বুআস যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটলে মদীনাবাসীরা তাদের নেতৃত্ব কর্তৃত্বের ভার অর্পণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এই আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের হাতে। সোজা কথায়, সে-ই ছিল মদীনার ভাবী সম্রাট। সে যখন বসে বসে কেবল দিন গনে যাচ্ছিল, ঠিক এমন সময় মদীনায় ইসলামের আবির্ভাব ঘটল। মানুষ দলে দলে ইসলামের দুর্গে দাখিল হতে লাগল।

এতে তার ভেতরে হিংসার আগুন জ্বলে উঠল। হিংসার চিতায় সে দিবানিশি জ্বলে পুড়ে মরতে লাগল। ইবনে হিশাম র. বলেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মদীনায় এলেন, তখন মদীনাবাসীরা আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সালুল আউফী কে তাদের রাজা বানানোর জন্য সর্বপ্রকার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিল। ইতঃপূর্বে আউস আর খাযরাজের লোকেরা কোনো ব্যক্তির ব্যাপারে এমন ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্তে আর কোনোদিন পৌঁছতে পেরেছিল না।

কিন্তু এমন সময় সেখানে ইসলামের আবির্ভাব ঘটল। এমনকি তার গোত্রের লোকেরা তাকে রাজমুকুট পরিয়ে দেওয়ার জন্যও সমস্ত বন্দোবস্ত আর আয়োজন প্রায় সম্পন্ন করে ফেলেছিল। ঠিক এমন সময় আল্লাহ তাআলা মদীনায় তাঁর রাসূল কে নিয়ে এলেন। অতঃপর যখন তার কওম ইসলামের দিকে দৌড়ে এলো, তখন এটা তার সহ্য হলো না। সে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে তার এক নম্বর দুশমন হিসেবে দেখল। তার মনে হলো, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এসেই তার রাজত্ব ছিনিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু তার কওমের সবাই যখন ইসলামে দাখিল হলো, তখন কোনো উপায়ান্তর না দেখে সেও বাহ্যত ইসলাম গ্রহণ করল। কিন্তু তার কলব ছিল তখনও জাহেলিয়াত আর নিফাকির অন্ধকার রাজ্যে।

মদীনাতে যার হৃদয়েই রোগ ছিল কিংবা ক্ষমতার প্রতি লোভ ছিল সে ইসলামের বিরোধিতা করতে শুরু করেছিল। এই নতুন দীন তাদের মোটেও সহ্য হচ্ছিল না। কারণ এই দীন তাদের আগের বানানো সবকিছু ধ্বংস করে দিচ্ছিল। তাদের সমস্ত পরিকল্পনা ভণ্ডুল করে দিচ্ছিল। মদীনার আগেকার সেই পরিস্থিতি ও পরিবেশ পুরোপুরিই বদলে গিয়েছিল। আগের সেই চেহারায় এখন মদীনাকে চেনা সম্পূর্ণই অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। মুহাজির আর আনসাররা মিলে মদীনায় এখন একটি নতুন জাতির আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল।

তারা একে অপরের সঙ্গে আত্মীয়তার বন্ধনে লীন হয়ে গিয়েছিলেন। তাদের সবার ঊর্ধ্বে ছিলেন প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তাঁর ভালোবাসার সামনে পৃথিবীর সমস্ত ভালোবাসা ছিল অর্থহীন। মুহাব্বত আর ভালোবাসার যেই গল্প আর উপন্যাস এতদিন পৃথিবীর মানুষের জানত, তা এখন তাদের কাছে ফালতু আর অর্থহীন মনে হচ্ছিল । এই প্রথমবারের মতো পৃথিবী এক নতুন ভালোবাসার স্বাদ পেয়েছিল। ইশক আর মুহাব্বাতের এক নতুন দৃশ্য পৃথিবীতে মঞ্চায়িত হচ্ছিল। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে তারা তাদের পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি, স্ত্রী-পরিজন এমনকি নিজের জানের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন।

এটা মুনাফিকদের মোটেও সহ্য হচ্ছিল না। তাই তারা রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে লাগল। তাঁর কোনো একটা ক্ষতির জন্য সর্বদা অপেক্ষার প্রহর গনতে লাগল। এভাবে মদীনাতে একটা ইসলাম বিরোধী শক্তির আবির্ভাব ঘটল।

ইসলামী সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে লাগল একটা ইসলামবিরোধী জীবাণু । যার কারণে মুসলমানদেরকে সর্বদা তাদের থেকে সচেতন থাকতে হচ্ছিল। কেননা এটা ছিল ইসলামের বাহ্যিক দুশমনদের চেয়েও অতি মাত্রায় ভয়ঙ্কর। কারণ 'ঘরের শত্রু বিভীষণ' এটা মুসলমানদের জানা ছিল ভালোকরেই। আর তখন থেকেই কুরআনে কারীম তাদের আলোচনা আর তাদের মুখ থেকে পর্দা সরিয়ে দিয়ে সুশ্রী চেহারার আবডালে তাদের কুশ্রী মুখাবয়বটা সবার সামনে উন্মুক্ত করে দেওয়ার পদক্ষেপ গ্রহণ করে। কারণ ইসলাম ও তাদের মাঝে ছিল একটি বিশেষ দেখাদেখি'। সীরাতের কিতাবের মধ্যে এই ব্যাপারে বিস্তারিত আলোকপাত করা হয়েছে। বক্ষ্যমাণ গ্রন্থেও আমরা জায়গায় জায়গায় এদিকে দৃষ্টি দিয়েছি।

 

হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর জিহাদী জীবন

 


No comments yet


Leave a comment

 


Name *:



Design theme color

Primary color


Alternative color