তায়েফের ঘটনা ও ইসলাম প্রচারে - tayfer ghotona
03:40:55 12/11/2023
তায়েফের ঘটনা ও ইসলাম প্রচারে : আবু তালিবের ইন্তেকালের পরে কুরাইশরা রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ওপর অত্যাচারের মাত্রা এত বেশি বৃদ্ধি করল- আবু তালিবের জীবদ্দশায় যার সাহস তারা পেত না। এমনকি কুরাইশের বেকুব ও হাবাগুলোও এখন তাঁর সঙ্গে বেয়াদবি শুরু করে দিয়েছিল। এক বোকা রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মাথায় মাটি ছুঁড়ে মেরেছিল।
এভাবে যখন কুরাইশদের নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি পেল, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তায়েফের পথে যাত্রা করলেন। কেননা তায়েফবাসীদেরকে নিয়ে তিনি অনেক বড় স্বপ্ন দেখতেন। আর সেটা অমূলক স্বপ্ন ছিল না। কারণ তায়েফ ছিল তাঁর শৈশবের বাসভূমি। তায়েফের নিকটবর্তী বনু সাইদ-ই তিনি ছোটবেলা লালিত পালিত হয়েছিলেন। আর সেখানে তাঁর দুধ. ভাই-বোন ও আত্মীয়-স্বজন ছিল।
তায়েফ
তায়েফ ছিল রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যিন্দিগির সঙ্গে জড়িত মক্কা ও মদীনার পরে তৃতীয় শহর। যা নবীজীর পদধূলিতে ধন্য হয়েছিল। আর তায়েফ সফর ছিল ইসলামের দাওয়াতের ইতিহাসে একটি বিশাল ঘটনা। কেবল সীরাতে নববীতেই নয়; বরং গোটা পৃথিবীর নবুওত আর রিসালতের ইতিহাসেও এটি যথেষ্ট গুরুত্ব আর তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ছিল। তায়েফে তিনি সর্বমোট দু'বার গিয়েছিলেন। প্রথমবার গিয়েছিলেন নবুওতের দশম বর্ষের শাওয়াল মাসে। আর দ্বিতীয়বার গিয়েছিলেন হিজরতের অষ্টম বর্ষের শাওয়াল মাসে। আর তাই অন্য যে কোনো শহরের তুলনায় এই সম্পর্কে একটু আলোচনার জোর দাবি রাখে। আর সে কারণেই আমরা এখন সংক্ষিপ্ত আকারে তায়েফের ভৌগোলিক, সামাজিক আর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা করব:
তায়েফ মক্কা থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রায় ৭৫ মাইল দূরে অবস্থিত একটি শহর। তায়েফ শহর মূলত গাযওয়ান নামক একটি পাহাড়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে আছে। গাযওয়ান পাহাড়ের উচ্চতা হলো প্রায় ছয় হাজার ফুট। আর এই শহরের নাম 'তায়েফ' হয়েছে শহরকে ঘিরে থাকা একটি দেয়াল বা প্রাচীরের কারণে। প্রাচীনকালে তার নাম ছিল 'ওজ'। কুরাইশের ধনকুবেরা মক্কার পাশাপাশি তায়েফেও নিজেদের জন্য কয়েকটি বাড়ি বানিয়ে রাখত।
শীতকাল তারা মক্কায় কাটাতো আর গ্রীষ্মকালের প্রচণ্ড গরমে চলে আসত তায়েফের বাড়িতে। আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিবেরও তায়েফে বেশকিছু জমি- জমা ছিল। ঐতিহাসিকগণ বলেন, অধিকাংশ কুরাইশের তায়েফে সম্পদ ছিল। মক্কা থেকে মাঝে মাঝে এসে সেগুলো তারা দেখে যেত। আর এভাবেই প্রচুর ধন-সম্পদ যা করে এই ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হলো না। এগুলো তায়েফবাসীকে অনৈতিকতা আর অশ্লীলতার দিকে ঠেলে দিলো।
সামাজিক বিশৃঙ্খলা তায়েফে চরমে পৌঁছে ছিল। সুদ, ব্যভিচার, মদ্যপান ইত্যাদিতে তায়েফের সমৃদ্ধ ও ধনকুবের শ্রেণীর ছিল চরম কুখ্যাতি। সেখানে মদ, কিশমিশ ইত্যাদির চাষ হতো খুব পরিমাণে। চামড়া দাবাগত করত। সুগন্ধির ব্যবসা ছিল জমজমাট। সেখানে পানির পরিমাণ ছিল প্রচুর। মাটি ছিল উর্বর। যার কারণে তায়েফে বাগানের সংখ্যা ছিল অগণিত। বিভিন্ন ধরনের ফল- ফসলে সমৃদ্ধ ছিল তায়েফ নগরী। আজও সেখানে তার এই বৈশিষ্ট্য রয়ে গিয়েছে।
জাহেলী যুগে এটা ছিল বিলানী লোকের গ্রীষ্মকালীন বিনোদন কেন্দ্র। ইসলামী যুগেও এটা বাকি ছিল। উমাইয়্যা কবি উমর ইবনে আবী রবীআর ভাষায়:
تشتو بمكة نعمة ومصيفها بالطائف
অর্থাৎ শীতকাল মক্কায় কতই না মজা ও আনন্দের। আর গ্রীষ্মকাল ঠিক তেমন তায়েফে।
আর তায়েফবাসীদের এই সমস্ত ধন-দৌলত, মাল-সম্পদ, জমি-জমা, সৌন্দর্য আর বিলাসিতা তাদের ভেতরে অহঙ্কার আর দাম্ভিকতার জন্ম দিয়েছিল। ঠিক যেমন আল্লাহ তাআলার ইরশাদ
وَمَا أَرْسَلْنَا فِي قَرْيَةٍ مِنْ نذير إِلَّا قَالَ مُتْرَفُوهَا إِنَّا بِمَا أُرْسِلْتُمْ بِهِ كَافِرُونَ (٣٤) قَالُوا نَحْنُ أَكثرُ أَمْوَالًا وَأَوْلَادًا وَمَا نَحْنُ بِمُعَذِّبِينَ (٣٥)
অর্থাৎ কোন জনপদে সতর্ককারী প্রেরণ করা হলেই তার বিত্তশালী অধিবাসীরা বলতে শুরু করেছে, তোমরা যে বিষয়সহ প্রেরিত হয়েছ, আমরা তা মানি না। তারা আরও বলেছে, আমরা ধনে-জনে সমৃদ্ধ, সুতরাং আমরা শাস্তি প্রাপ্ত হব না। [সূরা সাবা : ৩৪-৩৫]
আর বনু সাকীফ ছিল তায়েফের সম্মানিত ও নেতৃত্বদানকারী কবীলা। শুধু তায়েফ নয়; বরং গোটা আরবের মধ্যে বনু সাকীফ ছিল অন্যতম প্রসিদ্ধ ও শ্রেষ্ঠ কবীলা। তার শক্তি আর সম্পদ মানুষের মাঝে প্রবাদ প্রতীম হয়ে গিয়েছিল। তারা ছিল মুস্তারিবা তথা আদনানী আরব। ধর্ম, প্রতিমার শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে তাদের মাঝে আর কুরাইশদের মাঝে ছিল চিরদিনের প্রতিযোগিতা। বনু সাকীফ তাদের মূর্তি লাতকে মনে করত ঠিক তেমন, যেমন কুরাইশরা মনে করত হুবলকে। বরং লাতকে তারা কাবার প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করত। লাতের চারপাশেও তারা হারাম প্রতিষ্ঠা করেছিল।
তার চারপাশেও তারা সম্মান জানানোর জন্য সেই সকল প্রতীক আর বাহ্যিক বেশভূষা তৈরি করেছিল- যা কেবল কা'বা ঘরের জন্যই খাস ছিল। যখন আবরাহা তার বাহিনী নিয়ে মক্কায় বাইতুল্লাহ আক্রমণের জন্য এসেছিল, তখন এই বনু সাকীফ তাকে সাহায্য করেছিল। সে-ই আবরাহা বাহিনীকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আবু রিগাল নামক এক ব্যক্তিকে পথপ্রদর্শক হিসেবে দিয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগা আবু রিগাল রাস্তাতেই মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছিল। ফলে সে পরিণত হয়েছিল আরবদের কাছে ঘৃণার বস্তুতে। আরবরা তার কবরে পাথর নিক্ষেপ করত।
বনু সাকীফের লোকদের জীবন ছিল দারুণ সমৃদ্ধ। আর তারা বেশ আয়েশী জীবন যাপন করত। তাদের সম্পর্ক ছিল বনু উমাইয়্যার সঙ্গে। সম্পদ আর সম্মানের প্রতি ভালোবাসা, ব্যবসা-বাণিজ্য আর তিজারতের ক্ষেত্রে সমৃদ্ধি ইত্যাদি দিক থেকে তাদের মাঝে বেশ মিল-মিছিল ছিল। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার ইরশাদ করেন: কুরাইশ ও আনসার দুই মিত্র; বনু উমাইয়্যা ও বনু সাকীফ দুই মিত্র। বনু সাকীফের সরদার উরওয়া বিন মাসউদ ছিলেন আবু সুফিয়ানের কন্যা আমিনার স্বামী। এই আমিনার গর্ভে উরওয়ার সন্তান ছিল দাউদ বিন উরওয়া। অধিকাংশ মুফাসসিরীনে কিরামের মতে, মক্কাবাসীদের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ তাআলার এই বাণীতে বনু সাকীফই উদ্দেশ্য :
وَقَالُوا لَوْلَا نُزِّلَ هَذَا الْقُرْآنُ عَلَى رَجُلٍ مِنَ الْقَرْيَتَيْنِ عَظِيمٍ
অর্থাৎ তারা বলে, কুরআন কেন দুই জনপদের কোন প্রধান ব্যক্তির উপর অবতীর্ণ হল না? [সূরা যুখরুফ: ৩১]
বনু সাকীফের মধ্যে প্রসিদ্ধ আরেক ব্যক্তি হলেন হারিস ইবনে কালাদা। তিনি পারস্যে গিয়ে চিকিৎসা বিদ্যা শিখেছিলেন। পরবর্তীতে চিকিৎসক হিসেবে তিনি গোটা আরবজোড়া খ্যাতি লাভ করেন। তার পরে তার ছেলে নজরও প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তিনি ছিলেন রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর খালাতো ভাই।" তিনি বেশকিছু খ্রিস্টান পণ্ডিত ও গণকের সঙ্গে সাক্ষাৎ আর বিভিন্ন দেশ সফর করেছিলেন। দর্শন আর হিকমত সম্পর্কে তার অগাধ জ্ঞান ছিল। তিনি তার পিতা থেকে চিকিৎসা বিদ্যা শিখেছিলেন। কিন্তু এই নজর রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি চরম হিংসা আর বিদ্বেষ পোষণ করত ।
তাদের মধ্যে আরও প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন কবি উমাইয়্যা বিন আবী সালাত। তিনি ছিলেন মুখাযরামীন কবিদের অন্তর্ভুক্ত। যারা ইসলাম ও জাহেলী উভয় যুগ পেয়েছিলেন। পূর্ববর্তী আসমানী কিতাব বিশেষত তাওরাত সম্পর্কে তার খুব জানাশোনা ছিল। তিনি ছিলেন হানীফ তথা বিশুদ্ধ একত্ববাদে বিশ্বাসী। কিন্তু রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নবুওতের পরে বেটা লজ্জিত হলো। এবং নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি হিংসা বশত তাকে অস্বীকার করলো।
উল্টো কবিতার মাধ্যমে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বিরুদ্ধে মানুষকে উসকে দিতে লাগল। বদর যুদ্ধে কুরাইশদের নিহতদের ওপর সে শোকগাথা রচনা করেছিল। আল্লাহ তাআলার একত্ববাদ এবং হিকমত সম্পর্কে সে প্রচুর কবিতা রচনা করেছিল। তার সম্পর্কে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন, তার কবিতা ঈমান এনেছে; কিন্তু তার কলব কাফের হয়ে গেছে।
বনু সাকীফের ক্ষেত্রে যে বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তা হলো- নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ওফাতের পরে একমাত্র কুরাইশ আর বনু সাকীফ ব্যতীত সমস্ত আরব কবীলা মুরতাদ হয়ে গিয়েছিল। হাফিয ইবনে কাসীর র. বলেন, তায়েফে বনু সাকীফ ইসলামের ওপর অটল ছিল। তারা পলায়ন করেনি। এবং মুরতাদও হয়নি। ইসলামের যুদ্ধগুলি আর বীরত্বের ক্ষেত্রেও তাদের যথেষ্ট অবদান ছিল।
রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তায়েফের উদ্দেশে যাত্রা করার পেছনে দু'টি কারণ থাকতে পারে। হয়তো এ কারণে যে, এটা ছিল গোটা হিজাযের মধ্যে শক্তি-সামর্থ্য আর নেতৃত্বের দিক দিয়ে মক্কার পরেই দ্বিতীয় স্থানে। নয়তো এ কারণে যে, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মামারা ছিলেন বনু সাকীফের লোক। আর তাই তিনি বনু সাকীফের সাহায্য- সহযোগিতা ও নিজ কওমের লোক থেকে হিফাযতের আশায় তায়েফের পথে যাত্রা করেছিলেন ।
মক্কা আর তায়েফের মধ্যকার সরগরম সম্পর্ক আর যোগাযোগের কথা রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মতো একজন সচেতন মানুষের পক্ষে অজানা ছিল না। আর তাই তিনি এই অনুমান করতেও নিঃসন্দেহে ভুল করেননি যে, কুরাইশদের পক্ষ থেকে তাকে ও তাঁর দীনকে মিথ্যাচারের সংবাদ ততক্ষণে নিশ্চয়ই সেখানে পৌঁছে থাকবে। এতকিছু জেনেও তিনি কেবল তাঁর দাওয়াত আর রিসালত পৌঁছে দেওয়ার বাসনায় তায়েফের পথে ছুটে গিয়েছিলেন। এর দ্বারাই বোঝা যায়, আল্লাহর ওপর ভরসা ও আস্থা আর নববী হিম্মতের দিক দিয়ে কতটা ঊর্ধ্বে ছিলেন আমার পেয়ারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তায়েফে গিয়েছিলেন নবুওতের দশম বর্ষের শাওয়াল মাসে। ঐতিহাসিক ইবনে সা'দ, ২০০ ইবনে আসীর ২০১ ও মুকরিযী ২০২ উল্লেখ করেন- রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর তায়েফ সফরে আযাদকৃত দাস যায়দ বিন হারিসা রা. কে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন।
তায়েফে গুরুত্ব ও তাৎপর্য
জনসংখ্যার সমৃদ্ধি আর জীবনের বিস্তৃতি ইত্যাদি যাবতীয় দিক থেকে মক্কার পরেই স্থান ছিল তায়েফের বিতর্কের কথা তুলে ধরেছে এভাবে:
কুরআনে কারীম কুরাইশদের
وَقَالُوا لَوْلَا تَزَلَ هَذَا الْقُرْآنُ عَلَى رَجُلٍ مِنَ الْقَرْيَتَيْنِ عَظِيمٍ
অর্থাৎ তারা বলে, কুরআন কেন দুই জনপদের কোন প্রধান ব্যক্তির উপর অবতীর্ণ হল না? [সূরা যুখরুফ: ৩১]
তায়েফে লাতের মন্দির ছিল। এখানে তারা লাভের ইবাদত করত এবং তার জন্য হজ্জ করত। এই ক্ষেত্রে তারা লাতকে মক্কার হুবলের সমপর্যায়ের মনে করত। কারণ মক্কায় ছিল হুবলের মন্দির। আর হুবল ছিল কুরাইশের মূর্তি।
রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তায়েফে এসে সেখানকার বনু সাকীফের সম্ভ্রান্ত ও নেতৃস্থানীয় কিছু ব্যক্তিবর্গের কাছে এসে উপস্থিত হলেন। তাদেরকে তিনি আল্লাহ তাআলার দিকে ডাকলেন। তারা এটা ফিরিয়ে দিয়েছিল অত্যন্ত খারাপ তরীকায়। তারা রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ শুরু করে দিলো। তাদের বেকুব ও দাস- দাসীরা নবীজীর ওপর হামলে পড়ল। তাকে গালি দিতে লাগল। এক পর্যায়ে তাঁর ওপর পাথর নিক্ষেপ করতে লাগল।
রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন একটি খেজুর বাগানের দিকে এগিয়ে গেলেন। দুঃখভারে তিনি তখন ছিলেন জর্জরিত। খেজুর বাগানে তিনি বিশ্রাম নিতে লাগলেন। মুশরিকরা মক্কায় তাঁর সঙ্গে যা করেছিল তায়েফবাসীদের নির্যাতন ছিল আরও বেশি মারাত্মক। তায়েফবাসীরা রাস্তার দু'ধারে বসে যে-ই পারল তাঁর দিকে পাথর ছুঁড়ল। এতে তিনি রক্তাক্ত হয়ে গেলেন। একদিকে তায়েফবাসীদের তিনি রক্তস্নাত হচ্ছিলেন অপরদিকে তাঁর মুখ থেকে তায়েফবাসীদের হিদায়াতের জন্য দুআ বের হচ্ছিল।
নিজের দুর্বলতা, পাথেয়ের স্বল্পতা, আর নিজের কমতিকে তিনি দায়ী করছিলেন। আর আল্লাহর কাছে সাহায্য ও সহযোগিতার দুআ করছিলেন। তিনি বলছিলেন: হে আল্লাহ আমি আপনার কাছে আমার দুর্বলতা, পাথেয়ের স্বল্পতা আর মানুষের চোখে আমার সম্মানহীনতার অভিযোগ পেশ করছি। হে পরম করুণাময় দাতা দয়ালু! আপনি দুর্বলদের প্রভু। আপনি আমার রব। আপনি কাদের হাতে আমাকে তুলে দিয়েছেন? আপনি কি কোনো দূরের লোকদের হাতে আমাকে তুলে দিয়েছেন যারা আমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করবে। নাকি আপনি আমাকে শত্রুর হাতে তুলে দিয়েছেন- আপনি যাদেরকে আমার ওপর ক্ষমতাবান করে দিয়েছেন।
যদি আমার ওপর আপনার কোনো ক্রোধ না থাকে- তবে এ সবে আমার কিছুই আসে যায় না। তবে আপনার ক্ষমাই আমার জন্য প্রশস্ত। আমি আপনার ঐ নূরের আশ্রয় প্রার্থনা করছি- যার সামনে সমস্ত অন্ধকার কেটে যায়। দুনিয়া ও আখিরাতের সকল কর্ম সংশোধিত হয়ে যায়- আমার ওপর আপনার ক্রোধ অবতীর্ণ হওয়া থেকে কিংবা আমার ওপর আপনার রাগ নাযিল হওয়া থেকে। আপনি আপনার ওপর সন্তুষ্ট থাকলেই আমার জন্য যথেষ্ট। আর আল্লাহ তাআলা ব্যতীত আর কোনো শক্তি কিংবা সামর্থ্য নেই ।
আল্লাহ তাআলা তখন পাহাড়ের দায়িত্বে নিয়োজিত ফিরিশতাকে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট পাঠালেন। তিনি এসে আরয করলেন ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি নির্দেশ দিলে তায়েফকে ঘিরে থাকা পাহাড় দু'টিকে মিলিয়ে দিয়ে তাদেরকে চিরদিনের মতো শেষ করে দিতে পারি। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, না। তা কখনোই নয়। আমি চাই- আল্লাহ তাআলা এদের বংশধর থেকে এমন লোক সৃষ্টি করে দিন- যারা একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করবে। আর যারা তাঁর সঙ্গে অন্য কিছু শরীক করবে না।
যখন উতবা বিন রবীআ ও শাইবা বিন রবীআ রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর এই দুরবস্থা প্রত্যক্ষ করল তখন তাদের ভেতরে আত্মমর্যাদাবোধ জেগে উঠল। তারা তাদের আদ্দাস নামক একটি খ্রিস্টান গোলামকে বলল, একটি পাত্রে কিছু আঙ্গুর নিয়ে ঐ লোকটিকে দাও এবং তাকে খেতে বলো। আদ্দাস তাই করল। অতঃপর রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কথা শুনে এবং তাঁর আখলাক দেখে সে মুসলমান হয়ে গেল।
রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তায়েফ থেকে মক্কায় ফিরে এলেন। ততক্ষণে নিজ কওম তাঁর প্রতি ঠাট্টা আর বিদ্রূপ, উপহাস আর মশকরায় আরও কিছুদূর সামনে এগিয়ে গিয়েছে।
● হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর জিহাদী জীবন