ইসলামে নারীর মর্যাদা ও অধিকার : পটভূমি : ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে এ দিনটিকে ‘আন্তজাতিক নারী দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিল। যদিও ১৯৯১ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে। ইতিহাস পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয়, নারী শ্রমিক আন্দোলনের ফসল হচ্ছে নারী দিবস । ১৯৫৭ সালের এ দিনে আমেরিকার নিউইয়র্কের তৈরী পোশাক শিল্পে কর্মরত মহিলা শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের আন্দোলনে নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছিল। এ ঘটনা ছিল নারীদের প্রতি পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বহিঃপ্রকাশ।
প্রতিবাদের ধারাবাহিকতায় নিউইয়র্ক শহরেই ১৯১৮ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল বিশাল নারী সমাবেশ। ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেন হেগনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। সেখানে ৮ মার্চকে বিশ্ব নারী দিবস হিসেবে পালনের প্রস্তাব করেন। জার্মান নেত্রী ক্লারা সেকিন। ১৮৫৭ সালে শুরু হওয়া পুঁজিবাদী শোষণ- নির্যাতনের প্রতিবাদের সূত্রে ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘ এ দিবসটি তার সদস্য দেশ সমূহে পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো ।
ইসলাম পুরুষতান্ত্রিক ধর্ম নয় আবার নারীবাদি ব্যবস্থাও নয়
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানবজাতিকে দুটি লিঙ্গে বিভক্ত করে সৃষ্টি করেছেন । একটিকে করেছেন নর, অপরটি করেছেন নারী। পবিত্র কোরআনে কারিমে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নরকে সম্বোধন করে কথা বলেছেন, আবার নারীকেও সম্বোধন করে কথা বলেছেন।
প্রশ্ন হল, ইসলাম কেমন ধর্ম? এটা কি পুরুষতান্ত্রিক ধর্ম না নারীবাদি ধর্ম। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ প্রশ্ন আমাদের মনে স্বাভাবিক কারণে জাগতে পারে। ইসলাম ধর্ম কি পুরুষের জন্য নাযিল হয়েছে না নারীর জন্য নাযিল হয়েছে? বর্তমান পৃথিবীতে একটি শ্রেণী আছে যারা নিজেদেরকে নারীবাদি বলে পরিচয় দান করে এবং নারীবাদের বিপরীতে তারা পুরুষতন্ত্র নামে একটি পরিভাষা আবিষ্কার করেছে । পৃথিবীর মানুষকে তারা দুই ভাগে বিভক্ত করেছে। একটি হল পুরুষতন্ত্রের পক্ষে, অপরটি হল নারীবাদের পক্ষে ।
এই প্রেক্ষাপটে বহু লেখক কিংবা অনেক লেখিকা ইসলামকে নারী বিদ্বেষী ধর্ম হিসেবে চিত্রায়ণ করতে চায়। তাদের ধারণা, ইসলাম হল পুরুষতান্ত্রিক ধর্ম। যখন বছরের চাকা ঘুরে জাতিসংঘ ঘোষিত ৮ই মার্চ ‘নারীদিবস’ আসে তখন এই কথাগুলো বিশেষভাবে উচ্চারিত হয়। এই জন্য দুই হাজার পাঁচের নারী দিবসের আগেই আমরা মুসলিম যুবক সহ তাবৎ মানুষের কাছে এই কথা উত্থাপন করতে চাই যে, ইসলাম নর-নারী উভয় লিঙ্গের কল্যাণকামী জীবনাদর্শ।
অবহেলিত নারীকে লাঞ্চনার ঘূর্ণাবর্ত হতে উদ্ধার করে ইসলাম মহান মর্যাদার আসনে করেছে সমাসীন। আমরা স্পষ্ট করতে চেষ্টা করব, ইসলাম পুরুষতান্ত্রিক ধর্ম নয়, আবার এটি কোন নারীবাদি ধর্মও নয় । ইসলাম হচ্ছে উভয়ের জন্য নাযিলকৃত আল্লাহর পবিত্র বিধান। পুরুষের জন্যও পথপ্রদর্শক আবার নারীর জন্যও ইসলাম পথপ্রদর্শক। এজন্য আল্লাহ পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় বলেছেন-
من ذكر او انثى
“নর হও বা নারী হও।” অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা বলছেন, হে নর! তোমার জন্য আমি আমার এই বিধানকে নাযিল করেছি। হে নারী। তোমার জন্যও আমি নাযিল করেছি, কাজেই ইসলাম নারী-পুরুষ উভয়ের ধর্ম। উভয় শ্রেণীর কল্যাণের জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আল-কোরআন নাযিল করেছেন। ইসলামকে আবির্ভূত করেছেন ।
নারীর জীবিত থাকার অধিকার :
ঐতিহাসিক যে প্রেক্ষাপটে ইসলামের আগমন ঘটেছে তখন নারীদের অবস্থা ছিল নিতান্ত শোচনীয় । সেকালের নারীর অবস্থা আর ইসলামের আগমণের পর নারীর অবস্থা তুলনা করলে স্পষ্ট হবে যে, নারী জাতির মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মুখ্য অবদান রেখেছে পৃথিবীর বুকে ইসলাম । ইসলামের আগমনের পূর্বে একজন নারীর বাঁচার অধিকার পর্যন্ত ছিল না। ইতিহাস বলে, আরব সমাজে কোন কন্যা সন্তানের জন্ম হলে লজ্জা অনুভব করত পিতারা। ` অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন হয়ে যেত, তারা ভাবত আমার ঘরে কি করে নারী সন্তান হল । আমি কি পাপ করলাম যে, আমার ঘরে মেয়ে হল ।
কুরআন বলে-
واذا بشر احدهم بالانثى ظل وجهه مسودا فهو كظيم
“যখন তাদের কাউকে কন্যার সু-সংবাদ দেয়া হত তার চেহারা কালো হয়ে যেত যেন তা কয়লা” । কোন পিতার কাছে খবর আসল যে তোমার মেয়ে হয়েছে তখন সাথে সাথে তার হাস্যোজ্বল চেহারা কয়লার মত কালো হয়ে যেত। তারা নিষ্ঠুরভাবে নিজের ঔরসজাত সন্তানকে জীবন্ত মাটি চাপা দিত। ইসলামের আগমনের পর আল্লাহ পাক কোরআনে করীমের মাধ্যমে স্পষ্ট ঘোষণা করেছেন, হে মানুষ! যে স্বীয় কন্যাকে জীবন্ত মাটি চাপা দাও, মনে রাখবে কিয়ামতের ময়দানে এই কন্যা সন্তানকে আদালতে উপস্থিত করা হবে,
তাকে জিজ্ঞেস করা হবে কোন অপরাধ তুমি করেছিলে যার কারণে তোমার বাবা তোমাকে মাটি চাপা দিয়েছে? তোমাকে জীবন্ত দাফন করেছে? জবাব দাও। আসলে মেয়েকে প্রশ্ন করা উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য হল তার অভিভাবককে আতংকিত করা। অভিভাবক যে অপরাধ করেছে সে অপরাধ বিশাল। এর কোন সদুত্তর সে দিতে পারবেনা ।
এজন্য মেয়েকে প্রশ্ন করা হবে-
واذا الموء ودة سئلت بای ذنب قتلت
“জীবন্ত মাটি চাপা দেয়া মেয়েদেরকে প্রশ্ন করা হবে কোন্ অপরাধে তোমাদেরকে মাটি চাপা দেয়া হয়েছে?” আজকে তোমাদের কণ্ঠকে খুলে দেয়া হল তোমরা বল, তোমাদের বাবাদের বিরুদ্ধে কথা বলার অধিকার আছে, তোমরা বল ।
তাহলে বুঝা যায় বাঁচার অধিকার যে লিঙ্গের ছিলনা, বাঁচার অধিকার যে জাতির ছিলনা, ইসলামের কারণেই তারা বাঁচার অধিকারটুকু পেয়েছে এবং মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।