হাবিল ও কাবিলের কাহিনী - Habil Kabiler ghotona
13:51:35 06/12/2024
হাবিল ও কাবিলের কাহিনী
কা‘বীল ও হাবীলের ঘটনা, হযরত আদম (আ) এরই ঘটনার অবিচ্ছেদ্য অংশ বিধায় এখানে তার উল্লেখ করা হল। পবিত্র কুরআনে হযরত আদম (আ)- এর এই দুই পুত্রের নাম বর্ণনা করা হয়নি, বরং আদমের পুত্রদ্বয় শব্দ দ্বারা তাদের প্রসঙ্গে উপস্থাপন করা হয়েছে। অবশ্য তাওরাতে কাবীল ও হাবীল নামে তাদের বর্ণনা করা হয়েছে। এদের ঘটনা সম্পর্কে হাফিযে হাদীস, ইমাদুদ্দীন বিন কাসীর তাঁর ইতিহাস প্রন্থে সুদ্দীর বরাতে একটি রেওয়াতের উব্দৃতি দিয়েছেন, যা হযরত আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রা) এবং অন্য কয়েকজন সম্মানীত সাহাবী থেকে বর্ণিত হয়েছে। রেওয়াতের বিষয়বস্তু নিম্নরূপঃ
বিশ্বে মানব বংশ বিস্তারের জন্য হযরত আদম (আ) এই নিয়ম বেঁধে দিয়েছিলেন হযরত হাওয়ার গর্ভ থেকে যে জোড়া জোড়া সন্তান ভূমিষ্ঠ হত তাদের এক জোড়ার ছেলে মেয়েকে অন্য জোড়ার ছেলে মেয়ের সাথে বিবাহ বন্ধন আবদ্ধ করে দিতেন। এই নিয়মের অধীন কাবীল ও হাবীলের শাদীর ব্যাপারটি ছিল মীমাংসাধীন। কাবীল ছিল বয়সে বড় এবং তার সহোদরা ছিল হাবীলের সহোদরার চাইতে অধিক সুন্দরী। একারণে কাবীলের কাছে এটা খুবই অপছন্দনীয় ছিল প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী হাবীলের সহোদরার সাথে তার বিবাহ হোক এবং হাবিলের শাদী হোক তার (কাবীলের) সহোদরার সাথে। হযরত আদম (আ) বিষয়টির মীমাংসা করলেন এভাবে যে, তারা কাবিল ও হাবিল উভয়ে নিজ নিজ কুরবানী আল্লাহ তাআলার দরবারে উপস্থাপন করবে এবং যার কুরবানী গৃহীত হবে সেই আপন ইচ্ছা পূরণের যোগ্য বলে বিবেছিত হবে।
তাওরাত থেকে জানা যায়,ঐ যুগে কুরবাণী (মানত) কবুল হওয়ার এই ঐশী দস্তুর ছিল কুরবাণীর বস্তুকে কোন উচু জায়গায় রেখে দেয়া হত এব আকাশ থেকে এক খন্ড আগুন নেমে এসে তা ভন্ম করে দিত। যা হোক, ঐ নিয়ম অনুযায়ী হাবীল তার পাল থেকে একটি মোটা তাজা দুম্বা আল্লাহর উদ্দেশ্যে মানত করল এবং কাবীল তার উৎপাদিত শস্য থেকে নিকৃষ্ট শ্রেণীর কিছু শস্য কুরবানীর উদ্দেশ্যে উপস্থাপন করল। উভয়ের উপস্থঅপনকৃত কুরবাণী থেকেই তাদের সৎ বা অসৎ উদ্দেশ্যের হাদীস পাওয়া গেল। কাজে কাজেই আগুন স্বাভাবিকভাবেই হাবীলের পেশকৃত মাংসটি ভঙ্খ করে দিল এবং সার্থক হলো তার কুরবাণী।
কাবীল তার এই অবমাননাকে সহ্য করতে পারল না। সে রাগে একেবারে আগুন হয়ে হাবীলকে বলল, আমি তোকে অবশ্য অবশ্যই হত্যা করবো, যাতে তোর মনোবাঞ্ছা পূরণ না হয়। হাবীল উত্তরে বললো, আমি তো কোন মতেই তোমার উপর হাত তুলবো না, অবশিষ্ট তোমার যা ইচ্ছা তাই করতে পারো। আর কুরবাণীর ব্যাপারে আমার বক্তব্য এ যার উদ্দেশ্য সৎ, আল্লাহ তায়ালা তার কুরবাণীই গ্রহণ করেন। এখানে সৎ উদ্দেশ্য পোষণকারীর ধমকিতে যেমন কাজ হয় না, তেমনি কাজ হয় না অযথা ক্রোধে। কাবীলের ক্ষেত্রে এই উপদেশ কিরূপ কাজ করলো। সে ক্রোধে একেবাগে সর্বহারা হয়ে হত্যা করল আপন সহোদরকে।
কিন্তু কুরআনে শাদী বা বিবাহ কাহিনীর কোন বর্ণনা নেই। শুধু কুরবানীর (মানুষের) বর্ণনা আছে। অবশ্য সেই সাথে হাবীলের মৃতদেহ দাফনের ঘটনাটিও বর্ণনা করা হয়েছে।
হত্যাকান্ডের পর, মৃতদেহের কি করবে, সে চিন্তায় কাবীল একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়লো। তখন পর্যন্ত আদমের বংশের কেউ মৃত্যুমুখে পতিত হয়নি। তাই মৃত্যের সৎকারের ব্যাপারে আদম (আ) তখন পর্যন্ত আল্লাহর কোন নির্দেশ পানতি। যাহোক হঠাৎ কাবীল দেখতে পেল, একটি কাক ঠোঁট দিয়ে ঠুকরিয়ে জমিতে একটি গর্ত করে ফেললো। কাবীল তখন সজাগ হয়ে ভাবলো আমাকেও আমার ভাইয়ের জন্য এরূপ গর্ত খুঁড়তে হবে। (আল বেদায়া ও ননে হায়াঃপ্রথম খগু ঃপৃষ্ঠা ৯৩)
কাবিল এই ঘটনা প্রত্যক্ষ করার পর নিজের নিবুর্দ্ধিতার উপর আক্ষেপ করে বললো, আমি এই কাকের চেয়ে অধম। কেননা নিজের অপরাধ গোপন করার, এর সমপরিমাণ বিচক্ষণতাও আমার নেই। সে লজ্জা ও অপমানে মাথা হেট করল। অতপর ঐ কাকের অনুকরণেই আপন সহোদরের মৃতদেহ মৃত্তিকাগর্ভে সমর্পন করলো।
আমাদের দুই পুত্রের বৃত্তান্ত তুমি তাদেরকে যথাযথ ভাবে শোনাও যখন তারা উভয়ে কুরবানী করেছিল তখন একজনের কুরবানী গ্রহণ হল এবং অপরজনের গ্রহণ হল না। তাদের একজন বললো, আমি তোমাকে হত্যা করবোই। অপরজন বললো, আল্লাহ সংযমীদের কুরবাণী গ্রহণ করেন। আমাকে হত্যা করার জন্য তুমি হাত তুললেও তোমাকে হত্যা করার জন্য আমি হাত প্রসারিত করব না, আমি তো বিশ্বজগতের প্রভুকে ভয় করি। তুমি আমারও তোমার পাপের ভার বহন কর এবং অগ্নিবাসী হও এটাই আমি চাই এবং এটা অত্যাচারিদের কর্মফল।
অতপর তার চিত্ত ভ্রাতৃহত্যায় তাকে উত্তেজিত করল এবং সে তাকে হত্যা করলো। ফলে সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তভূর্ক্ত হলো। অতপর আল্লাহ এক কাক প্রেরণ করলেন, যে তার ভাইয়ের মৃতদেহ কিভাবে গোপন করা যায় দেখানোর জন্য মাটি খুঁড়তে লাগল। সে বললো, হায় আমি কি এই কাকের মতও হতে পারলাম না যাতে আমার ভাইয়ের মৃতদেহ গোপন করতে পারি! অতঃপর সে অনতপ্ত হলো। একারণেই বনি ইসরাইলের প্রতি এই বিধান দিলাম নরহত্যা অথবা পৃথিবীর ধ্বংসাত্মক কার্য করা হেতু ছাড়া কেউ কাউকে হত্যা করলে সে যেন পৃথিবীর সকল মানুষকেই হত্যা করলো, আর কেউ কারো প্রাণ রক্ষা করলে সে যেন পৃথিবীর সকল মানুষের প্রাণ রক্ষা করলো।(সূরাঃ মায়িদাহ, আয়াতঃ ২৭-৩২)
ইমাম আহমদ (রঃ) তার মুসনাদে হযরত আবদুল্লাহ বিন মাসউদ থেকে বর্ণিত নিচের রিওয়ায়েতটি উদ্বৃত করেছেনঃ রসূলুল্লাহ (স) বলেছেন,পৃথিবীতে যখনই অন্যায়ভাবে কোন হত্যাকান্ড সংঘটিত হয় তখন পাপের একটি অংশ অবশ্য অবশ্যই হযরত আদমের প্রথম পুত্রের (কাবীলের) ঘাড়ে গিয়ে পৌছে। কেননা সে প্রথম ব্যক্তি যে অন্যায় হত্যাকান্ডের সূচনা করে এবং প্রচলন করে এই ঘৃণা রীতির। (মুসনাদে আহমদ)
দামেস্কের উত্তরে হীলে কা‘সিইউন নামক একটি পর্যটনকেন্দ্র আছে যা মাক তালে হাবীল (হাবীলের হত্যাস্থল) নামে বিখ্যাত। এ প্রসঙ্গে ইবনে আসাকির (রা) আহমদ বিন কাসীরের একটি স্বপ্নের বর্ণনা দিয়েছেন। তাতে বলা হয়েছে তিনি (আহমদ বিন কাসীর) একদা রসূলুল্লাহ (স)-কে স্বপ্নে দেখেন এমতাবস্থায় তাঁর সাথে হাবীলও রয়েছে। হাবীল কসম করে বললো এটাই আমার হত্যাস্থল। তখন রসূল্লাহ (স) তার (হাবীলের) কথা সত্য বলে সমর্থন করলেন যাহোক, এটা হচ্ছে স্বপ্নের ব্যাপার। আর স্বপ্ন সত্য হওয়া সত্ত্বেও তা দ্বারা কোন দীনী বা ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেয়া যায় না।
হাবিল ও কাবিলের ঘটনায় শিক্ষ্যণীয় ব্যাপার
১ । সূরা মায়েদায় বর্ণিত শেষ আয়াত এবং উপরে বর্ণিত হাদীস আমাদের সামনে এ তথ্য উদঘাটন করছে মানব তার জীবনে কখনো যেন কোন পাপকর্ম উদ্ভাবন না করে (নতুন ভাবে কোন পাপ কর্মের সূচনা না করে।) কেননা এর পরিণাম হবে এই ভবিষ্যতে যে কেউ এই বিদআত (নতুন পাপকর্ম) করবে সঙ্গে সঙ্গে এর (পাপের) একটা অংশ সূচনাকারীর ঘাড়ে গিয়ে পৌছবে এবং এর উদ্ভাবক হওয়ার কারণে সে চিরস্থায়ী লাচ্ঞনা ও বচ্ঞনার অংশীদার হবে। পাপ সর্বাবস্থায়ই পাপ। তবে পাপের আবিষ্কার, আবিষ্কারকর্তার জন্য চিরস্থায়ী বিপদের কারণ (আমরা) এ থেকে আশ্রয় চাই।
২ । হাবীল ছিল আল্লাহর কাছে প্রিয়, আর কাবীল ছিল অভিশপ্ত। তাই হাবীলের পবিত্র দেহের যাতে অবমাননা না হয়, আদমের বংশধরদের সম্মান ও মর্তবা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য মৃত্যুর পার যাতে তাদের মৃতদেহ দাফন করার সুন্নাত (রীতি) জারী হয়ে যায়, কাবীলকে তার নির্লজ্জ আচরণের জন্য যাতে এ পৃথিবী ও অপমানিত হতে হয়, সে তার বুদ্ধিহীনতা ও অদূরদর্শিতার কথা যাতে হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে পারে সেজন্য আপন অপরাধ গোপন করার মত সাধারণ বিচক্ষনতাও তাকে দেয়া হয়নি, বরং এমন একটি পাখিকে এক্ষেত্রে তার পথ প্রদর্শক বানানো হয়েছে যার প্রতারণঅ, প্রবন্চনা এবং স্বভাবগত অপবিত্রতার কথা সর্বজন বিদিত। ফলে শেষ পর্যন্ত কাবীলকে স্বীকার করতেই হয় যে হায় আমি কি এই কাকের অনুরূপও হতে পারলাম না। (সূরাঃ মায়িদাহ, আয়াতঃ ৩২)
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. এর জীবনী